কোয়ান্টাম ৯: একটা বোরিং গল্প



কোয়ান্টাম ৯
একটা বোরিং গল্প

১।
নিলস বোরের ছোটবেলা কেটেছে প্রচণ্ড দুঃখ দুর্দশার মধ্যে। দারিদ্রের সাথে পাঞ্জা লড়ে, কষ্ট করতে করতে তিনি মানুষ হয়েছেন। তীব্র অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি সোনার মানুষ হয়েছেন।

না ।
গল্পটা এই টাইপের হলে খুবই এক্সাইটিং হতো, অনেকের আবেগে চোখ দিয়ে দুই চার ফোটা পানিও বের হয়ে যেত, গল্পটা এরকম না।
ডেনমার্কের কোপেনহ্যাগেনে গাটসমেয়ার গার্ড নামে একটা প্রাসাদতুল্য বাড়িতে নিলস বোরের জন্ম। বাবা নামকরা ফিজিওলজিস্ট। মা অত্যন্ত ধনী আর অভিজাত মহিলা। নিলস বোর ডেফিনিটলি চিন্তা করতে ভালবাসতেন, কিন্তু কষ্ট করে লেখালেখি তাঁর পোষাত না। বোরের ডক্টরেট থিসিসও নাকি তাঁর মা লিখে দেন!

এই গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম? শিখলাম যে বিজ্ঞানী হতে হলেই যে গরীব দুঃখী পরিশ্রমী হতে হবে এমন কোন কথা নাই। বোর এখন অঙ্ক করছে, তার মা মাথার কাছে দুধ নিয়ে বসে আছে। তাকে বিরক্ত না করে বরং তার বইগুলো দেখে আসি।

২।
এইটা বোরের ফিজিক্স বই। এইখানে তরঙ্গের কথা আছে। দেখি কি লিখেছে..
পানিতে ঢিল ছুড়লাম। ঢিলের ভারে পানির কিছু কণা সরে গেল।   ওই কণাগুলো আশেপাশের কণাকে ঠেলে তুলবে। একটা কণা তার পাশের কণাটাকে তুলবে, ওই কণা তুলবে তার পাশেরটাকে। যত জোরে ঢিল মারা হবে, তত বেশি শক্তি হবে, তত বড় ঢেউ হবে। একসময় অভিকর্ষের কাছে ঢেউ হার মানবে, উপরের দিকের কণাগুলো আছড়ে পরবে। পরার সময় আবার পাশের কণাগুলোকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে তুলবে। আবার আছড়ে পরবে। আবার টেনে তুলবে।
যদি মনে করি পানির তরঙ্গ X অক্ষ বরাবর যাচ্ছে, আর তরঙ্গের চুড়ার কণাগুলোর উচ্চতা হয়
0 1 2 3 2 1 0 -1 -2 -3 -2 -1 0
তাহলে তরঙ্গের বিস্তার 3. কোন দিকে তরঙ্গ হায়েস্ট 3 একক উঠে। তাই এর বিস্তার তিন।
পরপর দুইটা একই দিক থেকে আসা শূন্যের মাঝখানে কণা আছে কয়টা? ১২টা। এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১২।
যদি এক তরঙ্গদৈর্ঘ্য যেতে সময় লাগে .1 সেকেন্ড, ১ সেকেন্ডে ১০টা তরঙ্গদৈর্ঘ্য যায়। এই সময়ে একটা কণা 0 থেকে 3 পর্যন্ত উঠে, আবার 0 তে নেমে আসে, তারপর -3 তে নামে, তারপর আবার 0 তে ফিরে আসে। আমরা বলি, তরঙ্গের পর্যায়কাল 0.1 সেকেন্ড। ফ্রিকোয়েন্সি ১০।
ক্লিয়ার?

তরঙ্গ উঠছে নামছে। রাদারফোর্ডের ইলেকট্রন পরমাণুর চারপাশে ঘুরছে। বোরের মা দুধ নিয়ে বসে আছে। বোর অঙ্ক করছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সিনেম্যাটিক মিউজিক বাজছে। এইসব বোরিং দৃশ্য দেখতে দেখতে বোর বড় হয়ে যাবে। টাডা!

(এই পর্যন্ত এসে কোয়ান্টাম ২, E = hf আর কোয়ান্টাম ৬,  কেপলারের সূত্র পড়ে আসতে হবে। বোর বড় হয়েছে, বোরিং বোরিং সব অঙ্ক করছে, একটু পর সব মাথার উপরে দিয়ে যাবে । )

৩।
বোর রাদারফোর্ডের কাছে পড়েছে। সরি, পড়েছেন। রাদারফোর্ডের এগারো জন ছাত্র নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। বোরও রেডি হচ্ছেন।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলে ইলেকট্রন ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসে পরে যাবে। যদি না পরত কি হতো?

ধরি, মূল বিন্দুতে একটা বৃত্ত আঁকা হয়েছে। বৃত্তের ব্যাসার্ধ ১০ । ইলেকট্রন ঘুরছে ওই বৃত্ত বরাবর।
যখন x  = 10, y = 0
ইলেকট্রন বৃত্ত বরাবর উপরে উঠে। আস্তে আস্তে x কমবে, y বাড়বে।
বৃত্তের ব্যাসার্ধ একই থাকবে।
ব্যাসার্ধ হলো অতিভুজ। সাইন থিটার মান লম্ব/অতিভুজ।
এই জিনিসের ছবি আঁকলে হবে একটা পার্ফেক্ট সাইন কার্ভ।
ইলেকট্রন  ঘুরবে, তার ফিল্ড সাইন কার্ভের মতো কাঁপবে। আলোর তরঙ্গ ছড়াবে চারপাশে। ইলেকট্রনের ঘুরে আসতে যদি সময় লাগে T সেকেন্ড, তাহলে এক সেকেন্ডে ইলেকট্রন ঘুরবে f = 1/T বার।
ওই আলোর কম্পাঙ্ক f.

শুধু একটাই সমস্যা, ইলেকট্রন বিকিরণ করতে করতে আরও ছোট আরও ছোট ব্যাসার্ধের পথে ঘুরবে। একসময় নিউক্লিয়াসে পরে যাবে।

রাদারফোর্ডের মডেলকে বাঁচানোর একটা মাত্র উপায়। ইলেকট্রন ঘুরবে কিন্তু বিকিরণ করবে না।
কিভাবে সম্ভব?
ধরেন, এইটা ATM বুথ। শুধু ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট নেয়। আপনি যখন ৫০০ টাকা জমাতে পারবেন তখন টাকা শোধ করতে পারবেন।

বোরের মাথায় আইডিয়ার বাত্তি জ্বলল। পরমাণু একটা ৫০০ টাকার ব্যাঙ্ক। যখন ইলেকট্রন ঘুরে তার কম্পাঙ্ক থাকে f. কয়েকদিন আগে প্ল্যাঙ্ক আর আইনস্টাইন বের করেছেন E = hf.
সমাধান হলো, ইলেকট্রন পরমাণুর চারপাশে অনেকগুলো কক্ষপথে ঘুরতে পারে।
একটা কক্ষপথে যখন ঘুরবে, শক্তি শোষণ বিকিরণ কিছুই করবে না। সে ৫০০ টাকা জমাবে। একসময় যখন টাকা হবে, ওই টাকা দিয়ে ব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে দিয়ে সে নিচের স্তরে যাবে। আবার কখনো কখনো ব্যাঙ্ক থেকে ৫০০, ১০০০ টাকা নিয়ে উপরে উঠবে।

hf পরিমাণ শক্তি শোষণ করলে ইলেকট্রন লাফ দিয়ে এক নাম্বার থেকে দুই নাম্বারে যায়। বিকিরণ করলে আবার ব্যাক করে। ওই বিকিরণ আমরা দেখি তরঙ্গ আকারে। দুই স্তরের শক্তির পার্থক্য ডেল্টা E হলে, ডেল্টা E = hf.

f জানতে হলে আগে তাই জানতে হবে দুই স্তরের শক্তি  E1 আর E2. এই ক্ষেত্রে বোর একটা চাল চাললেন। কক্ষপথের শক্তিকে ধরে নিলেন কক্ষপথের ব্যাসার্ধের ব্যাস্তানুপাতিক। একমাত্র ওই কাজ করলেই শক্তির পার্থক্য আসে ডেল্টা h.

আবার নতুন নতুন অনুমান আসলো। বোর

f জানি। f থেকে জানবো পর্যায়কাল T ।
কেপলারের তৃতীয় সূত্রে পর্যায়কাল বসালে বের হয়ে আসবে কক্ষপথের ব্যাসার্ধ R । T2 সমানুপাতিক R3.

বোর অঙ্কে ভালো। T বের হলো, R বের হলো। সেখান থেকে বের হলো কৌণিক ভরবেগ L = mvR. সব হিসাব শেষে বের হয়ে আসলো
mvR = nh/2×pi

n মানে কক্ষপথের নাম্বার। এক নাম্বার কক্ষপথে n = 1, ২ নাম্বারে n = 2  …

n এর আরেক নাম প্রিন্সিপাল কোয়ান্টাম নাম্বার।

৪।
প্রিয় পাঠক, বোরিং লাগছে? কিচ্ছু করার নাই, আমরা একটু দেখার চেষ্টা করছি এক E = hf নিয়ে বোর কতদূর যায়।
বোর ছিল জিনিয়াস। এই ছোট্ট একটা ইনফরমেশন নিয়ে সে ঘাটতে ঘাটতে পুরো পর্যায় সারণির রহস্য উদ্ধার করে ছাড়ে।

তারপর যখন প্রায় সবকিছু জানা শেষ, হুট করে একটা ছোট খটকা বোরের পরমাণু মডেলকে তাসের ঘরের মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। ইলেকট্রন ঘুরে না।
ইলেকট্রন একই সাথে কণা এবং তরঙ্গ।
ইলেকট্রন স্থির তরঙ্গের আকারে পরমাণুর চারপাশে থাকে।

এইসব কথা অনেক পরে হবে।
ইলেকট্রন তরঙ্গ মানে? কিসের তরঙ্গ?
বল কিভাবে কাজ করে? ফিল্ড লাইন দিয়ে? ফিল্ড লাইন কাঁপলে আলো তৈরি হয় তাইতো?
কারো মাথায় একবারও প্রশ্ন আসে নি এই লাইন, এই ফিল্ড, এই তরঙ্গ আসলে কি জিনিস?
কি আসলে কাঁপে?

বোরের গল্প চলবে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Bohr_model

Leave a Reply