১: রাস্তা



১.

আক্কাস আলী যে কি চিজ মফিজ অবশেষে টের পেয়েছে। এখন টের পেয়ে খুব একটা লাভ নাই, আরও আগে টের পাওয়া উচিত ছিল। এখন কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারলে হয়।

ঘন দুর্যোগের রাত। আকাশে ঝিলিক মারছে বিদ্যুতের শিখা। আশেপাশের গাছপালা জন্তুর মতো কাঁপছে। পুরা রাস্তায় একটা জন মানুষ নাই। বাজ পরছে দূরের ফাঁকা মাঠে, দুপাশে অজানা জংগলের গহীনে। আর পরছে মফিজের মাথার ভেতরে। 

এই ঘন দুর্যোগের রাতে তার পেছনে লেগেছে তিনটা পুলিশের গাড়ি। ঝড় বৃষ্টির তীব্র শব্দ ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠছে তাদের তীব্র সাইরেনের শব্দ। সেই সাইরেনকে ইসরাফিলের শিঙার মতো লাগছে তার। গর্জনের সাথে সাথে উপড়ে উপড়ে আসছে যেন চারপাশের মাতাল গাছপালা!

মফিজ শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। গাড়ি বারবার পিছলে যাচ্ছে। কাঁদা ছিটকে পড়ছে চারদিকে। ঘন কালো অন্ধকার রাস্তা আরো অন্ধকার হচ্ছে তাতে। খুব তাড়াতাড়ি কোন বাইপাস রোডে না নামলে আজকে কপালে আসলেই কেয়ামত আছে তার। বাংলাদেশের পুলিশ এত অ্যাক্টিভ, ভাবা যায়!! 

২.

কি এমন পাপ করেছিল মফিজ? কি কারণে তার এই অবস্থা? আক্কাস আলীর এমন আক্রোশ কেনই বা নেমে আসলো তার উপর?

শুধু তো কয়েকটা মাস্কই। আলুর ব্যাপারী আক্কাস আলী চায়না থেকে অর্ডার দিয়ে লাখ দশেক মাস্ক এনেছিল। দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে, আলুর চেয়ে মাস্কের ব্যবসায় এখন শতগুণ লাভ। একটা মাস্কের দাম এখন দুই হাজার টাকা, এই সিজনে মাস্ক বেঁচে আক্কাস আলীর ঘরে উঠবে দুইশো কোটি।

এই দশ লক্ষ মাস্ক থেকে মাত্র দশ হাজার মাস্ক মফিজ সরিয়েছিল। না সরিয়ে উপায় আছে? ড্রাইভারি করে করে আক্কাস আলীর আলুর বস্তা টেনে আর কতদিন? তার একটা ভবিষ্যত আছে, ঘরে বৌ বাচ্চা আছে, ঘরের বাইরে গার্লফ্রেন্ড আছে। এভাবে চলা যায়?

কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল প্রতিটা মাস্কের ভেতরে মাইক্রোচিপ লুকানো থাকবে? বাড়ি থেকে একশো মিটার যেতে না যেতেই তিনটা পুলিশের গাড়ি পেছনে লেগে যাবে? একবারে মৌমাছি, সরি, করোনা ভাইরাসের মতো পেছনে লেগে থাকবে? কে ভাবতে পেরেছিল দেখে দেখে আজকের দিনেই এমন ঝড়বৃষ্টি আসবে! যাই হোক, বেঁচে ফিরতে পারলে আক্কাস আলীকে উচিত শিক্ষা দেবে সে, দাঁতে দাঁত চেপে ভাবলো মফিজ। আপাতত জান বাঁচানো ফরজ।

৩. 

মফিজ এক্সেলারেটরে চাপ দিলো। পুলিশের গাড়ি একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে ঘাড়ের উপর ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে কোন ক্ষুধার্ত জন্তু।

এই যখন অবস্থা, ডানে ঘন জঙ্গলের ভেতর বিদ্যুতের আলোতে মফিজের চোখে পড়ল একটা বাইপাস রাস্তা। ঠিক যেন তার জন্যই অপেক্ষা করে আছে রাস্তাটা।

মফিজ বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরালো। তীক্ষ্ণ বাঁক দিয়ে ঢুকে গেল রাস্তায়। রাস্তার শুরুতে সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল, নির্মনকাজ চলছে, সামনে রাস্তা বন্ধ। মফিজ পরোয়া করলো না। একটু পর হেডলাইটের আলোয় ঝলমল করে উঠলো আরেকটা সাইনবোর্ড – সামনে যাবেন না – এই রাস্তায় যে গিয়েছে সে আর কোনদিন ফিরে আসে নি। মফিজ তার পরও কেয়ার করলো না। সোজা গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো রাস্তায়।

Image may contain: car and outdoor


৪.

পুলিশ ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজ মফিজকে ডানে ঢুকতে দেখলেন। সাথে সাথে তিনি চেইস থামানোর আদেশ দিলেন। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন মফিজ চিরদিনের জন্য তাদের হাতের নাগালের বাইরে।

তিনগাড়ি ভর্তি পুলিশ ঝড় বৃষ্টির রাতে গভীর জঙ্গলে তাকিয়ে দেখলো এক অদ্ভুত অপার্থিব দৃশ্য। মফিজের গাড়ির গতি যেত অতি অতি ধীর হয়ে আসলো। তার গাড়ির শব্দ ভোঁতা হতে হতে একসময় আর শোনা গেল না। তার গাড়ির আলো আস্তে আস্তে লাল হতে হতে মিলিয়ে গেল। তাদের মনে হলো সামনে রাস্তাটা যেন অসীম, তার কোন শেষ নেই। সেই অসীম বিস্তৃত রাস্তার দিকে অতি ধীরে ধীরে  মফিজ এগিয়ে গেল। তার সামনে ঘন কালো একটা অন্ধকার পর্দা। ইমতিয়াজ সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন মফিজ অতি ধীরে ধীরে ঘন কালো ওই পর্দার কাছে এসে একসময় থেমে গেল, পর্দা স্পর্শ না করেই!

৫.

ছোট একটা রাস্তা, লেখা দেখাচ্ছে ফুলবাড়িয়া ৫ কিলোমিটার। কিন্তু গাড়ি চালাতে এমন লাগছে কেন মফিজের? মনে হচ্ছে রাস্তাটা তাকে টানছে সামবের দিকে। মনে হচ্ছে গাড়ির সামনের জায়গাটা আস্তে আস্তে লম্বা হচ্ছে।

কি মনে করে মফিজ পেছনে তাকালো। বাইরে দুনিয়া কেমন জানি বদলে গেছে। পুলিশের গাড়িগুলো অদ্ভুত রকমের নীল হয়ে গেছে। পুরা দুনিয়াই নীল হয়ে গেছে। শুধু তাই না, সময় যেন অস্বাভাবিক দ্রুত চলছে বাইরে। চারগুণ স্পিডে চলা মুভির মত সবকিছু নড়ছে। মাতাল গাছপালা তাদের নীল নীল ডালপালা প্রচন্ড আক্রোশে ছুড়ছে চারপাশে।

ভয়ের একটা তীব্র স্রোত মফিজের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল। আচমকা ব্রেক কষলো সে। লাভ হলো না। রাস্তার সামনের দিকে কিছু একটা হিরহির করে টানতে টানতে তাকে সামনে নিয়ে গেল। তার গাড়িটাকে টেনে লম্বা করে ফেলল। তীব্র টান পড়লো তার শরীরে।

মৃত্যুর আগের কয়টা মুহূর্ত মফিজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পারলো এক মিনিটে ঝড় থেমে গেল, ত্রিশ সেকেন্ডে রাত কেটে সূর্য উঠলো, দশ সেকেন্ড পর আবার সূর্য ডুবলো, আর তার পরের পাঁচ সেকেন্ডে দুইবার সূর্য উঠলো আর ডুবলো!

৬.

ব্ল্যাক হোল, ওয়ার্ম হোল আর জেনারেল রিলেটিভিটির অপার্থিব রহস্যময় জগতে তোমাকে স্বাগতম!

2 thoughts on “১: রাস্তা”

Leave a Reply