গভীর সমুদ্রে ৬: মা



গভীর সমুদ্রে ৬
মা

১।
গভীর সমুদ্র।

১৪০০ মিটার মানে প্রায় ৪২০০ ফুট। একটা ৪২০ তলা বিল্ডিংকে উলটা করে ডুবালে যত গভীর হবে তত।

ব্রুস রবিনসন তাঁর সাবমারসিবল নিয়ে দেখতে এসেছেন সেখানকার আশ্চর্য সব প্রাণীদের।

মিডনাইট জোনে নিকষ কালো অন্ধকার। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভূতুরে সব দানবেরা।
এই জগতে খাবারের খুব অভাব। হয় শিকার হও নাহলে শিকার করো এইটার এখানকার নিয়ম।

এই দানবদের রাজ্যে দেখা মিলল পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের একজনকে। একটা মা অক্টোপাস। কিছুদিন আগে সে ডিম দিয়েছে। তার বাসায় ছোট ছোট অস্রুদানার মতো ঝুলছে ১৬০টা ডিম।

এই ডিমগুলো মূল্যবান। মা অক্টোপাস জীবনে মাত্র একবারই ডিম পারে। সে জানে এদেরকে কিভাবে রক্ষা করতে হয়। একটু বাসা ছেড়ে গেলে আশেপাশের শিকারিরা তার ডিম চুরি করে ফেলবে। মা অক্টোপাস তাই কোনদিন বাসা ছাড়ে না।

ডিমগুলো বড় হচ্ছে। শেওলা যাতে না জমে সেগুলোকে কিছুক্ষণ পরপর নাড়া চাড়া করে দিতে হয়। অক্সিজেনের যাতে কোন রকম অভাব না হয় সেজন্য একটু পরপর বাতাস দিতে হয়। যেকোনো প্রাণী আশেপাশে আসলে তাদের তাড়াতে হয়। মা অক্টোপাসের কাজের শেষ নেই।

ব্রুসের টিম ২৮ দিন পর ফিরে আসলো। মা অক্টোপাস বাসা ছাড়ে নি। অক্টোপাসের ডিম ফুটতে অস্বাভাবিক সময় লাগে। এই গভীর সমুদ্রের অক্টোপাস ডিমের ভেতর থাকে প্রায় চার বছর। এই চার বছরে ব্রুসের টিম বারবার ঘুরে গেছে, এক বারের জন্যও মা অক্টোপাসকে বাসা ছাড়তে দেখে নি। এই জগতে খাবারের খুব অভাব, ঘরের কাছে খাবার ঘুরঘুর করে না। এই চার বছরে মা অক্টোপাসকে একবারের জন্যও খেতে দেখা যায় নি।

আস্তে আস্তে দিন যায়। ডিমগুলো ছোট থেকে বড় হয়। মা অক্টোপাস এক মুহূর্তও তাদের চোখের আড়াল করে না। তার বেগুনী চামড়া আস্তে আস্তে ধুসর হয়ে ওঠে। তার চোখ মেঘাচ্ছন্ন হয়।

বাচ্চা ফুটতে প্রায় ৫৩ মাস লাগে। এই ৫৩ মাস মা অক্টোপাস না খেয়ে থাকে। গভীর সমুদ্রে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। এই অস্বাভাবিক কম তাপমাত্রা, গর্ত থেকে অযথা বের হয়ে শক্তি খরচ না করা মা অক্টোপাসকে বাঁচিয়ে রাখে। একসময় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সময় হয়। অক্টোপাস মা তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে বাচ্চাদের ডিমের উপর বাতাস দিয়ে তাদের বের হতে সাহায্য করে। তারপর তার কাজ শেষ হয়।

বাচ্চা জন্মের পরপরই মা অক্টোপাস মারা যায়। ব্রুসের টিম পরেরবার ফিরে এসে তার দেহটাকে আর কোথাও খুঁজে পায় নি।

(এই কাহিনী শুধু এই বিশেষ গভীর সমুদ্রের অক্টোপাসের না, পৃথিবীর সব অক্টোপাস মাদের। গভীর সমুদ্রের এই অক্টোপাসের ডিম ফুটতে সাড়ে চার বছর লাগে, অন্য জায়গায় হয়তো লাগে কয়েক মাস। এই সময়টা বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক সময় মা অক্টোপাসকে নিজের পা ছিরে খেতে দেখা গেছে, তবু সে বাসা ছেড়ে যায় নি। )

(মা দিবসের বিশেষ লেখা)

Leave a Reply