তোমরা জানো কি, এইযে এই মুহূর্তে আমি মোবাইলে লেখাটা লিখছি, কারো কারো সাপেক্ষে এই সময়ই ঢাকার অদূরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে, একটু দূরে মুঘল সম্রাট শাহজাহান মমতাজের পেইন্টিং এর দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছেন, আর বহু দূরে আফ্রিকার জঙ্গলে টি রেক্স হুঙ্কার দিচ্ছে? সব একই মুহূর্তে?
চলো দেখে আসি একটা মুহূর্তের আসলে অর্থ কি। এই পর্বের অনুপ্রেরণা জি এর রিলেটিভিটি আর ব্রায়ান গ্রিনের দ্য ফেব্রিক অভ স্পেস টাইম।
১.
একটা ট্রেন বাম থেকে ডানে চলছে। ট্রেনে দুই ঝগড়াটে প্রফেসর লাল বাবু আর সাদা বাবু তর্ক করছেন।
এদের একজন কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভুল প্রমাণ করেছেন, আরেকজন রিলেটিভিটি কোয়ান্টাম মেকানিক্স। দুই জনই ট্রেনে বসে উচ্চস্বরে চিৎকার চেচামেচি করছেন। একই ট্রেনে নোবেল কমিটির কিছু সদস্য আছেন। তারা হতভম্ভ, লাল বাবু সাদা বাবুর মধ্যে কাকে নোবেল দেওয়া উচিত বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রথমে ভাবলেন, যে বেশি জোরে চিৎকার করে নিজের থিওরি বলতে পারবেন নোবেল প্রাইজ তার। পরে এই চিন্তা বাদ দিতে হলো। ট্রেনের হুইসেলের শব্দে চিৎকার চেচামেচি ভালো শোনা যাচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো, দুইজনকে ট্রেনের দুই পাশে পাঠানো হবে। দুইজন যত দ্রুত সম্ভব তাদের পেপার লেখা শেষ করে হাই স্পিড ওয়াই ফাই দিয়ে ট্রেনের মাঝখানে থাকা সার্ভারে আপলোড করে দেবেন। বাটন প্রেস করার পর পেপার আলোর গতিতে সার্ভারে চলে আসবে। যার পেপার আগে আপলোড হবে, সেই পাবে নোবেল প্রাইজ।
দুই প্রফেসর ঝগড়া ভুলে টাইপিং শুরু করলেন। একটু পর দুইজনেই সেন্ড বাটন প্রেস করলেন। নোবেল কমিটি অবাক হয়ে দেখলো, দুইজনের লেখাই একেবারে একই সময়ে সার্ভারে আপ হয়েছে। বিরস মুখে লাল বাবু, সাদা বাবু দুইজনকেই নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হলো।
এক দিনের ব্যবধানে রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নাম পৃথিবী থেকে মুছে গেলো।
২.
এদিকে ট্রেনের পাশ দিয়ে বাইকে করে যাচ্ছিলেন মহান বিজ্ঞানী ইব্রাহিম ভাই। তিনি আর কিছু জানেন না জানেন, এটুকু জানেন আলোর বেগ ধ্রুব।
রিলেটিভিটি ভুল হলে, আলোর বেগের সাথে ইব্রাহিম ভাইয়ের বাইকের বেগ যোগ বিয়োগ হতো। সেটা তো হওয়া সম্ভব না। আলোর বেগ একই থাকবে। আলোর বেগকে একই রাখতে হলে কি করতে হবে? স্পেস আর সময়কে চেঞ্জ হতে হবে।
ইব্রাহিম ভাই দাবি করলেন, নোবেল কমিটি পার্শিয়াল্টি করেছে। লাল বাবু সাদা বাবু মোটেও একই সময়ে সেন্ড করেন নি। সার্ভার মোটেও ট্রেনের মাঝখানে ছিল না।
লাল বাবু ছিলেন ট্রেনের পেছনে। তিনি লাইট মেরেছেন ট্রেনের গতির দিকে। তার আলোর বেগ ইব্রাহিম ভাইয়ের বাইকের তুলনায় কম হওয়া উচিত ছিল, হবে না। এদিকে সামনে থাকা সাদা বাবু আলো মেরেছেন উল্টা দিকে। তার আলোর বেগ ইব্রাহিম ভাইয়ের বাইকের তুলনায় বেশি হওয়া উচিত ছিল, সেটাও হবে না।
ইব্রাহিম ভাই তাই দাবী করলেন, পেছনে থাকা সাদা বাবু আসলে লাল বাবুর পরে সাবমিট করেছেন। তার আলোকে অল্প দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সামনে থাকা সাদা বাবুই নোবেলের দাবীদার, তিনি লাল বাবুর অনেক আগে পেপার লেখা শেষ করেছেন।
ইব্রাহিম ভাই নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানালেন। দুই জনকে নোবেল ভাগ করে না দিয়ে কেবলমাত্র সাদা বাবুকে দেওয়ার দাবী জানালেন। সাদা বাবু তাদেরই ছাত্র, তাঁর আসল নাম সফেদ আলী। অন্য কেউ নোবেল নিয়ে যাবে এটা তিনি সহজে মানতে পারলেন না।

৩.
বিজ্ঞানী সুশীল শান্তি ট্রেনের উল্টাদিকে স্পিড বোটে যেতে যেতে দেখলেন পুরা উল্টা দৃশ্য। লাল বাবু নিঃসন্দেহে আগে বাটন চেপেছেন, নোবেলের দাবীদার তিনি। শান্তি নিজেও বহুদিন ধরে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ভুয়া প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এত বড় একটা আবিষ্কারকে সাদা বাবুর তুচ্ছ পেপারের সাথে শেয়ার করা লাগবে সেটা তিনি কিছুতেই মানতে পারলেন না। আলফ্রেড নোবেলের নামে মরণোত্তর মামলা ঠুকে দিলেন।
৪.
এবার খেয়াল করো, নোবেল কমিটির সদস্যের কাছে দুইটা ঘটনাই একই সময়ে হয়েছিল। ঠিক।
এদিকে ইব্রাহিম ভাই, সুশীল শান্তি এদের কারও কাছেই এই দুইটা ঘটনা একই সময়ে হয় নি। আরও আজব ব্যাপার হলো, কোনটা আগে কোনটা পরে হয়েছিল এ নিয়েও দুইজনের ভেতর মতভেদ দেখা যাবে।
তার মানে, নোবেল কমিটির সদস্যের কাছে যে ঘটনাগুলো একই মুহূর্তে হয়েছে মনে হয়েছিল, ইব্রাহিম ভাই, সুশীল শান্তির কাছে সেগুলোকে একই মুহূর্তে মনে হবে না।
নোবেল কমিটির কাছে যে মুহূর্তে দুই বাবুই লেখা শেষ করেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই বক্কর ভাইয়ের এজেন্টরা আক্কাস আলির ব্যাঙ্ক একাউন্ট হ্যাক করে।
ইব্রাহিম ভাই এদিকে একদিন আগেই দেখেছেন বক্কর ভাইয়ের ব্যাঙ্ক একাউন্ট হ্যাক হওয়া। আজকে দেখলেন লাল বাবু সাদা বাবুকে নিয়ে নোবেল কমিটির ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
সুশীল শান্তি এখনও জানেনই না যে আক্কাস আলীর একাউন্ট হ্যাক হয়েছে। তার সাথে একটু আগেই আক্কাস আলীর ফোনে কথা হয়েছে। সব ঠিকঠাক আছে বলেছেন। আক্কাস আলী টেরও পায় নি আর একদিন পরেই তার মাথায় বাঁশ পরতে চলেছে।
এদিকে বহু দূরের গ্যালাক্সিতে বাস করতে থাকা লক্কর আপু দেখছেন, যে সময়ে আক্কাস আলী হ্যাক করছেন, একই সময়ে আফ্রিকার জঙ্গলে ডাইনোসর হুঙ্কার দিচ্ছে।
৫.
মাথা নষ্ট করা প্যারাডক্স। কিন্তু তোমরা যেহেতু ম্যাথ পছন্দ করো না, ফেসবুকের লেখায় সমীকরণ আনলে লেখা কেউ পড় না, তাই সেসব দিয়ে অযথা আর বড় করছি না। সেগুলো বইয়ের জন্য রেখে দিলাম।
দীপংকর মিত্র
সাদা বাবু কোথায় ছিলেন? ট্রেনের সামনে না পিছনে?