প্যালিওজিন



প্রাচীন পৃথিবী সিরিজ। আগের পর্বগুলো এখানে: https://nayeem.science/category/biology/ancient-earth/

এই পৃথিবীতে হোমো স্যাপিয়েন্স নামের প্রাণী এসেছে খুব বেশি হলে এক লক্ষ বছর আগে। সেখানে ডাইনোসররা এখাবে রাজত্ব করেছিল পনেরো কোটি বছর ধরে। আজ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে মেক্সিকোর চিক্স্যাল্যাবে ভয়াবহ এক উল্কা নেমে আসে, তাই ছাই ভস্ম ছড়িয়ে পড়ে স্ট্র‍্যাটোস্ফিয়ার জুরে। সূর্যের আলোর অভাবে প্রথমে বড় গাছ, পরে মাঝারি গাছ আস্তে আস্তে মারা যায়। অন্ধকারে ক্ষুধায় কাতর হয়ে ধুকে ধুকে মরে ২৫ কেজির বেশি ওজনের সকল স্থলচর প্রাণীরা। শেষের দিকে ঠান্ডায় হিমশীতল হয়ে যায় পৃথিবী।
https://nayeem.science/2019/06/27/ক্রেটাসিয়াস-২/

তারপর প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিশ্বজোড়া শীতল ডাইনোসরের কবরস্থানে সূচনা হয় নতুন যুগের – প্যালিওজিন। গত পনেরো কোটি বছর যে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ডাইনোসরদের লাথি ঘুঁতা খেয়ে উঠে দাড়াতে পারতো না, আজ এতদিন পর তারা সুযোগ পেল। কিছুদিন পর হিম শীতল পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে আসলো, সবুজ পাতা, ঘাস আর ফুলে ফুলে ভরে গেল চারদিক। নতুন পৃথিবী ভরে গেল নতুন বাসিন্দাদের দিয়ে।

চলুন ঘুরে আসি প্যালিওজিনের দুনিয়া থেকে!

১.
কলাম্বিয়ার গহীন জঙ্গল। পাঁচ কোটি নব্বই লাখ বছর আগে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে, কিন্তু জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে না। পাশের মজা ডোবা কুয়াশা ছড়াচ্ছে, সে কুয়াশা পাক খেয়ে খেয়ে আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে বন জুরে। বড় বড় বুদবুদ অদ্ভুত শব্দে ফাটছে ডোবাটার মাঝখানে, একটা বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

আপনি বসে আছেন ডোবার ধারে বড় গাছটার মাচায়। টাইম মেশিনে করে খাওয়ার জন্য যে তিনটা ছাগল এনেছিলেন তাদের দুইটাই শিকার হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। কিছু একটা আসে নিঃশব্দ, আস্ত গিলে ফেলে শিকারকে, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায় জলার দিকে।

মাঝ রাত। মশামাশির প্রচন্ড উপদ্রব, তার পরও ঝিমুনির মতো হয়েছিল। নিচের নিস্তরঙ্গ জলায় হঠাৎ ঝটপট নড়াচড়ার শব্দে ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে।.450 বোরের রাইফেলটা তাক করলেন নিচের দিকে।

বেশ বড় সড় একটা কুমির বের হয়ে আসলো জলা থেকে। পনেরো ফুট লম্বা হবে অন্তত। এই শালাই তাহলে কালপ্রিট। রাইফেলটা তাক করে ট্রিগারে হাত রাখলেন। চোখের নিচ বরারর গুলি করতে হবে।

একটা মশার কামড়, এক মুহূর্তের ইতস্তত আপনাকে বাঁচিয়ে দিলো। রাইফেলের ঘোড়া টিপলে সর্বোনাশ হয়ে যেত নাহলে। কারন একটু আগে পনেরো ফুট লম্বা যে কুমিরটা মাটিতে দাড়িয়ে ছিল, সে এখন আছে মাটি থেকে দশ ফুট উপরে। বাঁচার জন্য ছয়ফট করছে।

জলা থেকে উঠে আসা পয়তাল্লিশ ফুট লম্বা এক টন ওজনের সুবিশাল সাপ মহাদানব টাইটানোবোয়ার মুখের মধ্যে পনেরো ফুট লম্বা কুমিরটাকে টিকটিকির মতো লাগছে। নিষ্পৃহ, নিশ্চল সবুজ চোখ মেলে সে দেখছে চারপাশের কুয়াশাঘেরা প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবী। আশেপাশের পুরা দুনিয়া শান্ত, নিশ্চল হয়ে গেছে, শুধু বোঁটকা গন্ধের রাজত্ব করছে অনুভূতি জুরে। আপনি কি কাঁপছেন? মাচা কাঁপছে কি টকঠক করে? সাবধান, সর্পরাজ ঘুরে তাকাবে!

২.
ডাইনোসর শেষ, পৃথিবীতে এসেছে নতুন দানবরা। অ্যামাজনের জঙ্গলে জলাভূমিতে তখন রাজত্ব করছে দানবাকার সাপ টাইটানোবোয়া, ওদিকে ইংল্যান্ড আর বেলজিয়ামের বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে দানব পাখি গ্যাস্টর্নিস।

সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, সাড়া গায়ে পালকভর্তি, ছোট একটা লেজ, ছোট দুইটা ডানা। ক্রেটাসিয়াস যুগে প্রায় হুবহু তার মতো দেখতে পালক ওয়ালা রোমশ ডাইনোসর ছিল। তার ঠোটটা টিয়া পাখির মতো, কিন্তু অনেক বড়, কেমন জানি বিভৎস। এই জাতীয় ঠোঁটকে বলে নাটক্র‍্যাকার। জঙ্গলে ছোটাছুটি করে কর্কশ চিৎকার করে শিকার খুঁজে চলেছে সে, সাবধানে থাকাই ভালো। আফটার অল, ডাইনোসরের বংশধর সে, রক্তে মিশে আছে পশুশক্তি।

৩.
কিন্তু পাখিদের যুগ, সাপদের যুগ বেশিদিন থাকবে না। স্তন্যপায়ীরা ছড়িয়ে পড়ছে সাড়া পৃথিবীতে। আমেরিকার জংগলে পনের ইঞ্চি লম্বা মিনি বিড়ালের সমান এক ধরনের প্রাণী দেখা যাচ্ছে। আকারে বিড়ালের সমান হলেও দেখতে সে পুরোদস্তুর ঘোড়া। নাম তার প্রোটো হিপ্পাস। হিপ্পাস কথাটার মানে ঘোড়া। প্রোটো হিপ্পাস মানে আদি ঘোড়া। কিছুদিন পরেই তাদের জায়গা নেবে কুকুরের সমান সাইজের ইওহিপ্পাসরা।

এসেছে আদি খরগোশ, ইওমিস নামের উড়ন্ত কাঠবিড়ালি গ্লাইড করে বেড়াচ্ছে ডালে ডালে। আদিম চামচিকা কিচমিচ করছে সন্ধ্যার জঙ্গলে। দশ ফুট লম্বা অ্যাম্বুলোসিটাস হচ্ছে তিমির পূর্বপুরুষ। এরা এখনও মাটিতেই আছে, শক্ত চারটা পা এখনও বিবর্তিত হয়ে পাখনা হয়ে যায় নি। জলার ধারে মাঝে মাঝেই এদের সশব্দে পানিতে আঁছড়ে পড়তে দেখা যায়।

বাঘ সিংহ ভালুকের এখনও দেখা মেলে নি। রাতের মঙ্গোলিয়ার মরুভূমিতে চোখ লাল করে, সাড়ে তিন ফুট লম্বা পাথায় ঝকঝকে শিকারী দাঁত নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অ্যান্ড্রুসার্কাসের দল। মাংসাশী হিংস্র এই শুকর একেকটা তেরো ফুট লম্বা, তাদের শক্ত চোয়ালটায় অস্বাভাবিক শক্তি ধরে। শুকরের এই পূর্বপুরুষ এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় স্থলচর শিকারী ম্যামাল।

৪.
চারপাশে বিচিত্র সব প্রাণী, কেউ শিকার কেউ শিকারী। এর মাঝে জার্মানির জঙ্গলে গাছে গাছে নেচে বেড়াচ্ছে তেইশ ইঞ্চি লম্বা ছোট একটা প্রাণী। গাছের পাতা, ফল আর বীজ খেয়ে তার দিন কাটে। মাঝে মাঝে বড় বড় শিকারী দাবড়ানি দেয়, সে দৌড়ে মুখ লুকায় ডাল পালায় তৈরি তার ছোট বাসাটায়।

সেদিনের প্রাণীজগতের এসব ভাবার মতো বুদ্ধি ছিল না। যদি থাকতো তাহলে বুঝতো এই নিরীহ গোবেচারা প্রাণীটার বংশধর একদিন সাড়া পৃথিবীর দখল নেবে। তাহলে বুঝতো এক দিন এর কারণে ঝাড়ে বংশে নির্বংশ হবে সব প্রাণীরা। যদি ভাবতো, বুঝতে পারতো একে কোনমতেই বাঁচতে দেওয়া উচিত হবে না।

মিট ডারউইনিয়াস – সকল বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি আর মানুষদের সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ!

Leave a Reply