(স্যাপিয়েন্স অবলম্বনে)
যে জিনিসটা হোমো স্যাপিয়েন্সের বিকাশে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল সেটা চাকা না, আগুণও না। সেটা হচ্ছে ভাষা। অন্য প্রাণিদেরও ভাষা আছে। একটা বানর আরেকটা বানরকে বলতেই পারে, নদীর ধারে যেও না, সেখানে বাঘ ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েন্সদের ভাষা এত সিম্পল না। আমরা বলতে পারি, আজ সকাল সাতটা ছিচল্লিশ মিনিটে আমি দেখেছি, নদীর ধারে তীরের সাথে ত্রিশ ডিগ্রি কোণে আট ফুট চার ইঞ্চি লম্বা হেলদি চেহারার ধূর্ত একটা বাঘ ঘুমিয়ে আছে! এই লেভেলের ভাষা এক দিনে আসে নি, তিল তিল করে বিবর্তিত হয়েছে।
ভাষা আবিষ্কার হওয়ার পর আমরা গল্প করতে শিখেছি। গল্প বানাতে শিখেছি। যে জিনিসগুলো হোমো স্যাপিয়েন্সকে সবচেয়ে বেশি এক করেছে সেটা ঠিক জ্ঞান বিজ্ঞান শেয়ার করা না। আদিম মানুষ সারাদিন খাঁটাখাটনি করে রাতে আগুনের পারে বসে গল্প করত, জানো, আজকে না আমি চাকায় স্পোক বসানো শিখেছি, বসানোর পর চাকা সেই স্ট্যাবেল হয়েছে – ব্যাপারটা ঠিক এমন না। তারা গল্প করতো, ঠিক যেমন আমরা এখনও করি – সখিনা কার সাথে ভাগসে জানস? আবুলের সাথে। কালকে দুইটাকে গাছতলায় একসাথে শুয়ে থাকতে দেখসি। – আবুলের সাথে? ঠিক দেখসস তো? কাইল সখিনার একদিন কি আমার একদিন!
এই গল্পগুলো, আলাপগুলো আমাদের সামাজিক করেছে, এক সাথে মিশতে শিখিয়েছে। আমরা দেশ, জাতি, ধর্ম এরকম নানা ধরণের আদর্শ বানিয়েছি, শেয়ার করেছি। নিয়ানডার্থালদের ব্রেইন মানুষের চেয়ে বড় ছিল, কিন্তু তাদের ভাষাজ্ঞান ছিল অনুন্নত। মাতৃভূমির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, এ ধরণের মহান আদর্শের জন্ম দেওয়া তাদের জন্য সম্ভব হয় নি। আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে স্যাপিয়েনরা ধীরে ধীরে, বারবার যুদ্ধে হারিয়ে নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্ত করে ছাড়ে।
ভাষার আবিষ্কার স্যাপিয়েন্সদের অনেকদূর নিয়ে যায়। ছোট ছোট গ্রাম গড়ে ওঠে। মুখে মুখে কাহিনী জন্মায়। চাকা তৈরির উপায় মুখে মুখে বাবা থেকে ছেলেতে যায়। নাগা মরিচ দিয়ে তিতির পাখির রোস্টের রেসিপি যায় মা থেকে মেয়েতে। সখীনার কাহিনী মুখে মুখে বড় হয়ে জন্ম হয় স্বর্গের ইন্দ্রানী সখিনেশ্বরী দেবী আর কুৎসিত দুই মাথাওয়ালা নরকের দানব আবুলেস্টাইনের গল্প!
সমস্যা হচ্ছে, মানুষের ব্রেইনের ধারণক্ষমতা খুব সীমিত। সে দশজন, বেশি হলে গ্রামের একশজন মানুষের আয় উপার্জন, খানাপিনার হিসাব রাখতে পারবে, এক হাজার জনের হয়তো নয়। সখিনার গল্প মুখে মুখে সখিনেশ্বরী দেবীর কাহিনী হয়ে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু ২০ আর ২০ এর যোগফল মুখে মুখে ২০২০ হয়ে গেলে বিশাল সমস্যা। শেষ পর্যন্ত হোমো স্যাপিয়েন্স এই সমস্যার সমাধান করে বিশাল এক আবিষ্কার করে – লিপির আবিষ্কার। মানুষের এই পর্যন্ত ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি আর গণিতে যতগুলো আবিষ্কার হয়েছে, তার মধ্যে ভাষা আর লিপির সমতুল্য আমি একটাও দেখি না।
মোটামুটি পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন ইরাকে মানুষের একেবারে প্রথম দিকের লিখিত ভাষা পাওয়া যায়। আর এই প্রথম আমরা জানতে পারি – মানুষের একটা নাম থাকে। একটা আলাদা স্বত্বা থাকে। এর আগে বিশাল যুদ্ধের প্রমাণ আছে, বড় বড় প্রাসাদের নমুনা আছে – কিন্তু জানার কোন উপায় নেই সেই প্রাসাদের অধিপতির নাম আসলে কি ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব সাড়ে তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরিয় মাটির ট্যাবলেটে পাওয়া যায় প্রথম নামধারী মানুষ – কুশিম।

কে এই কুশিম? কোন রাজা – মহারাজা? ধর্মপ্রচারক? বিখ্যাত কবি? বিজ্ঞানী? যোদ্ধা?
কি ছিল তার বাণী? কোন মহাকাব্য? যুদ্ধের বর্ণনা? ধর্মীয় বার্তা?
অনুবাদ পড়ছি:
২৯,০৮৬ একক বার্লি, ৩৭ মাস, কুশিম।

সোজা কথা, পৃথিবীর প্রথম লিখিত সাইন করা বাণী হচ্ছে কুশিম নামের কোন দোকানদার/হিসাবরক্ষকের চাল ডালের হিসাব! লিপির জন্ম হয়েছে চাল ডালের হিসাব রাখতে, মহান কোন উদ্দেশ্যে নয়!