কল্পবিজ্ঞান
১।
বিজ্ঞানী সুশীল শান্তি পঁচিশ বছর নিরলস গবেষণা করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, মাথার চুল সাদা করে অবশেষে তাঁর স্বপ্নের সমীকরণটা প্রতিষ্ঠা করলেন। এই সমীকরণ ব্যবহার করলে ডায়রেক্টলি ম্যাটার অ্যান্টিম্যাটার অ্যানিহিলেশানকে ব্যবহার করে শক্তি পাওয়া যাবে। রকেটের বেগ খুব সহজে আলোর ৯০% এ উঠবে। মানবজাতির নক্ষত্র ভ্রমণের স্বপ্ন অবশেষে সফল হবে।

সুশীল শান্তি কাঁপাকাঁপা হাতে সাবমিট বাটন প্রেস করলেন। পেপারটা বিজ্ঞান কাউন্সিলে চলে গেলো। এবার শুধুই অপেক্ষার পালা। পেপার অ্যাক্সেপ্ট করলেই শুরু হয়ে যাবে তাঁর স্বপ্নের রকেটের কাজ।
এদিকে সুশীল শান্তি টের পান নি, কিন্তু গত একশ বছরে দেশ অনেক উন্মত হয়েছে। সকল স্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুশীল শান্তির সূত্র তাই সর্বস্তরের জনগণের মতামতামতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো।
আলুর ব্যবসায়ী ইব্রাহীম খাঁ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। তাঁর মতামতের বিশাল দাম আছে। তিনি সমীকরণটি দেখলেন। সমীকরণের মাঝখানের কিছু জায়গায় তিনি সংশোধনী প্রস্তাব করলেন। ভ্যারিয়েবল s এর জায়গায় তিনি i লেখার প্রস্তাব করলেন। s মানে শান্তি, তার বদলে i মানে হচ্ছে ইব্রাহীম। শান্তি সমীকরণে তাই কাল্পনিক সংখ্যা যোগ হলো।
মাননীয় মন্ত্রী নরেশ চন্দ্র অনেক বিজ্ঞ মানুষ। যদিও তিনি অষ্টম শ্রেণী পাশ, কিন্তু তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। দ্বীন দুনিয়া সম্পর্কে তাঁর অনেক জ্ঞান। তিনি সমীকরণটির কয়েক জায়গায় যোগ চিহ্নের বদলে গুন চিহ্ন বসালেন। যোগ করলে একটা জিনিস আস্তে আস্তে বাড়ে। গুন করলে তরতর করে বাড়বে। তিনি অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, যোগের চেয়ে গুন অনেক বেশি পাওয়ারফুল।
জ্যোতিষী মহাশয় সমীকরণ নিয়ে বসলেন। সংখ্যা সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান। তিনি একটা নাম করা জ্যোতি-বিশ্ববিদ্যলয়ে নিউমেরোলজি পড়ান। তিনি সমীকরণ থেকে সকল ৫, ৮ এই সংখ্যাগুলো সরিয়ে ১৪ আর ২১ ঢুকালেন। এগুলো নিউমেরলজিক্যালি খুব পাওয়ারফুল সংখ্যা। শনির পাশ দিয়ে রকেট যখন মারাত্মক বেগে যাবে, এই সংখ্যাগুলো তাঁকে রক্ষা করবে।
বাবা শিন ঝু অনেক ঝানু পুরোহিত, ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখেন। এ ধরণের একটা সমীকরণ যে হবে, সেটা যে ধর্মগ্রন্থে বহু আগে থেকেই আছে, সেটা তিনি যুক্তি সহকারে প্রমাণ করলেন। তিনিও সমীকরণের কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করলেন। কয়েক জায়গায় আলোর বেগ c এর বদলে বাবার ল্যাম্বর্গিনি গাড়ির বেগ vl বসানো হলো। বাবা যুক্তি দিলেন, বিজ্ঞান আজ এক কথা বলে কাল আরেক, কিন্তু এই vl বেগটা গ্রন্থের সাথে মিলে, একসময় না একসময় বিজ্ঞান নিজেকে শুধরে নেবেই, আজ হলে ক্ষতি কি? বাবা শিন ঝু খুব যুক্তিবাদী মানুষ, তাঁর নামের সাথে যুক্তিবাদী কথাটা আছে।
সব শেষে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আকমল হোসেন শেষ একটা সংশোধনী দিলেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ মহিষমতি রায়বাহাদুর। তাঁর নামের বদলে সুশীল শান্তির মতো পাতি বিজ্ঞানীর নাম সমীকরণের সাথে একবারেই যায় না। সমীকরণের তাই নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো মহিষমতি সমীকরণ।
অবশেষে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা পেলো মহিষমতি সমীকরণ। রাস্তার বিলবোর্ডগুল বড় বড় করে ছেয়ে গেলো সমীকরণ আর মহিষমতির ছবি দিয়ে। টিভির বিজ্ঞাপনে সুন্দরিরা সুউজ্জল হাসি দিয়ে দন্ত বিকশিত করে সমীকরণের গুণগান বর্ণনা করতে লাগলেন।
সুশীল শান্তি তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। দুইদিন পর তার লাশ পাওয়া গেলো। দৈনিক দ্বিতীয় আলো পত্রিকার তৃতীয় পাতায় খুব ছোট করে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলে। তাঁর পুত্র অশীল অশান্তি ২০০টাকা খরচ করে বাবার মৃত্যুর খবরটা জানানোর একটা ব্যবস্থা করলেন।

২।
এক বছর পরের কথা।
আদালতে বিচারকার্জ চলছে।
জনগণের রায়ে প্রাপ্ত মহিষমতি সমীকরণ রকেট মানে নি। উপরে উঠে বুমেরাংএর মতো নিচে নেমে এসেছে। তার নাক থ্যাবড়া হয়ে গেছে।
এতো বড় ধৃষ্টতা কেউ মেনে নিতে পারছে না। আদালত ভর্তি মানুষ রাগে অপমানে কাঁপছে। বিচারক রায় দিতে গিয়ে কাঁপছেন। তাঁর হাতে আইনের বই থরথর করে কাঁপছে।
বিচারক রায় ঘোষণা করলেন। রকেটকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
জনগণ আনন্দে উল্লাস করে উঠলো। খুশির দমকে তাদের সাড়া শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলো।
নিষ্প্রাণ রকেট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। একটুও কাঁপল না।
তাকে কাঁপানোর মতো বায়ুপ্রবাহ ঘরে ছিল না।