টিনি মিনিদের জেনারেল রিলেটিভিটি ৫
স্পেশাল রিলেটিভিটি ১ঃ ফোটনের দুঃখের জীবন
গত পর্বে বলেছিলাম, ফ্ল্যাট স্পেসটাইম বলতে আমরা বুঝি যেখানে
ds^2 = -dt^2 + dx^2 + dy^y + dz^2 হয়।
এই সমতল দুনিয়ায় মেট্রিক টেনসরগুলোর মান হয় 1, যদিও সময়ের ক্ষেত্রে আলোর বেগ 1 ধরলে টেনসরের মান আসে -1 (c ধরলে -c^2).
এই সূত্রের নাম লরেঞ্জ ইনভ্যারিয়ান্ট। এর জন্ম স্পেশাল রিলেটিভিটি থেকে। আগামী কয়েকটা পর্বে আমরা ধাপে ধাপে এই সূত্র প্রমাণ করবো।
স্পেশাল রিলেটিভিটির প্রথম পর্ব ফোটনের দুঃখের জীবন। কিছুদিন আগে কোয়ান্টাম সিরিজে লিখেছিলাম, কপি করছি সেখান থেকে। প্রথম পর্বে ম্যাথ থাকবে না, তবে পর্বটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্পেশাল রিলেটিভিটিকে ফিল করতে না পারলে ম্যাথ বৃথা যাবে।
…
…
আপনি যদি ফোটন হতেন কি হতো? আপনার হাতে ম্যাজিক্যাল পাওয়ার থাকতো? ৮ মিনিটে চলে যেতেন সূর্য থেকে পৃথিবী? হুট হাট ঘুরে বেড়াতেন এখানে ওখানে?
চলুন ঘুরে আসি, ফোটনের দুনিয়া থেকে।
১।
পুরা ব্যাপারটার শুরু রিলেটিভিটি থেকে।
একটু বুঝাই।
পূর্ব দিকে সূর্য উঠে, পশ্চিম দিকে ডুবে।
তার মানে, পৃথিবী ঘুরছে পশ্চিম থেকে পূর্বে।
তার মানে হলো, পূর্ব দিক থেকে কোন আলো আসলে সেটার সাথে পৃথিবীর ঘুরার বেগ যোগ হবে।
আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার থাকবে না। একটু হলেও বাড়বে।
আবার, পশ্চিম দিক থেকে কোন আলো আসলে আলোর বেগ থেকে পৃথিবীর ঘোরার বেগ বিয়োগ হবে।
আলোর বেগ তিন লক্ষ থেকে কমে যাবে।
ঠিক না বেঠিক?
সবাই বলেন, ঠিক।
গুড।
বিজ্ঞানীরা মাপলেন।
ফলাফল হলো অবাক করা।
পুর্ব থেকে যে আলো আসলো সেটার বেগ পৃথিবীর বেগের জন্য এক ফোটাও বাড়ল না।
পশ্চিম থেকে যে আলো আসলো সেটার বেগ পৃথিবীর বেগের জন্য একটুও কমলো না।
মনে করেন একটা ট্রেইন সামনে বাতি জ্বেলে আপনার দিকে আসছে সেকেন্ডে ২ লক্ষ কিলোমিটার বেগে।
আপনি মরার জন্য ট্রেইনের সামনে দাড়িয়ে আছেন।
মরার আগে একটু শখ হলো আলোটার বেগ মাপার।
মাপবেন?
তিনে দুইয়ে পাঁচ রাইট?
তিন লক্ষ যোগ দুই লক্ষ সমান পাঁচ লক্ষ, ঠিক?
না। আলোর বেগ সব সময় তিন লক্ষ কিলোমিটার থাকবে। বাড়বে না, কমবেও না।
সুইজারল্যান্ডের প্যাটেন্ট অফিসের একজন অখ্যাত কেরানি এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে জগত বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁর নাম আইনস্টাইন।
এই ব্যাখ্যার নাম রিলেটিভিটি।
একটু বুঝাই।
বেগ মানে দূরত্ব/সময়।
যদি আমি বেগ বাড়াতে না, দূরত্ব আর সময় চেঞ্জ হয়ে যাবে।
ধরেন বেগের লিমিট সেকেন্ডে ৩০০ কিলো।
এর বেশি বেগ কোনমতেই সম্ভব না।
আমি ঢাকা থেকে রংপুর যাবো।
দূরত্ব প্রায় তিনশো কিলো।
আমি তো কোনভাবেই বেগ তিনশো কিলোর উপর তুলতে পারবো না। তাহলে কি আমি ১ সেকেন্ডের কম সময়ে রংপুর যেতে পারবো না?
অবশ্যই পারবো।
আমার বেগ, তিনশো কিলোর যত কাছাকাছি যাবে, ঢাকা থেকে রংপুরের রাস্তাটা আমার জন্য তত ছোট হবে। সময়ও কমে যাবে।
একসময় হয়তো আমি দেখবো রংপুর বাড়ির পাশে চলে এসেছে।
মাত্র তিন কিলো দূরে।
ওই তিন কিলো জায়গা আমি যাবো ধরেন .011 সেকেন্ডে।
আমার বেগ তাহলে কতো হবে?
3/.011 = 272.72 কিলো সেকেন্ডে।
তাহলে কি হচ্ছে?
আমি বেগ বাড়ানোর চেষ্টা করবো, বেগ বাড়বে না, রাস্তা ছোট হবে। সময়ও কমবে।
আমি রাস্তার সাপেক্ষে যে বেগে চলছি, রাস্তা কিন্তু আমার সাপেক্ষে একই বেগে উলটা দিকে চলছে।
ঠিক যেই লজিকে আমি রাস্তাকে ছোট হতে দেখবো, একই লজিকে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একজন আমাকে ছোট হতে দেখবে।
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লোকটার কাছে আমি ছোট হয়ে যাবো।
তার কাছে রাস্তা ছোট হবে না।
একই সমান থাকবে।
তার কাছে রাস্তা স্থির, সেজন্য।
তার মানে, তার কাছে রাস্তা তিন কিলো না, তিনশো কিলোই থাকবে।
আমি রাস্তার সাপেক্ষে আমার বেগ মেপেছি 272.72 কিলো/সেকেন্ড।
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লোকটিও একই বেগ মাপবে।
কিন্তু সে রাস্তার দৈর্ঘ্য মাপবে ৩০০ কিলো, তিন কিলো না।
আবারও, বেগ = দূরত্ব/সময়।
সময় = দূরত্ব/বেগ
= 300/272.72
= 1.1 সেকেন্ড।
তাহলে, আমার .011 সেকেন্ড সময়টা সে দেখবে 1.1 সেকেন্ড ধরে।
১০০ দিয়ে গুন করলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আমার .011 × 100 = 1.1 সেকেন্ড সময়টা সে দেখবে 1.1 × 100 = 110 সেকেন্ড ধরে।
আমি এই 1.1 সেকেন্ডে একটা মশা মারলে, সে দেখবে আমি 110 সেকেন্ড ধরে খুবই ধীরে ধীরে মশাটা মারছি।
কেন দেখবে?
কারণ, আমি তার সাপেক্ষে অনেক দ্রুত বেগে চলছি।
আমি তার সাপেক্ষে অনেক দ্রুত বেগে চলছি মানে, সেও আমার সাপেক্ষে অনেক দ্রুতবেগে উলটা দিকে চলছে।
তার মানে,
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লোকটা যখন এক সেকেন্ড ধরে মশা মারবে, আমিও সেটাকে ৯০ সেকেন্ড ধরে দেখবো।
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লোকটা যেমন আমাকে ছোট (চ্যাপ্টা) হতে দেখবে, আমিও তেমনি রাস্তা আর লোক দুইজনকেই ছোট আর চ্যাপ্টা দেখবো।
ক্লিয়ার??
বেগের লিমিট তিনশো কিলো না, সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলো।
বেগ যোগের সূত্র v’ = u + v না,
v’ = (u + v) / (1 + uv/c^2)
আপনি যেভাবেই তরণ দেন, যেভাবেই বেগ বাড়ানোর চেষ্টা করেন, এই সূত্রে বসিয়ে দেখেন, আপনার বেগ কখনও আলোর বেগে নিতে পারবেন না।
কিন্তু খুব কাছাকাছি যেতে পারবেন।

২।
ভয়েজার সেকেন্ডে প্রায় ১৭ কিলোমিটার বেগে চলছে।
সূর্যের পর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রটা থেকে আলো আসতে সময় লাগে চার বছর।
ভয়েজারের সেই দূরত্ব যেতে লাগবে প্রায় আশি হাজার বছর।
এবার ধরেন,
ধরেন ভয়েজারকে আপনি তরণ দিচ্ছেন।
বেশি না, মাত্র 1 g.
সেকেন্ডে 9.8 মিটার।
এইভাবে যদি মাত্র এক বছর তরণ দেওয়া যায় তাহলে আপনি আলোর বেগের ৭৭% বেগে পৌছবেন।
এই এক বছরে পৃথিবীতে কেটে যাবে 1.19 বছর।
আপনি যদি ৫ বছর এভাবে তরণ দেন, আপনি আলোর বেগের 99.999% বেগে পৌছবেন।
এই ৫ বছরে পৃথিবীতে কেটে যাবে ৮৩ বছর।
আপনি পৃথিবী থেকে প্রায় ৮৩ আলোকবর্ষ দূরে থাকবেন।
পৃথিবীর মানুষ আপনার উচ্চতা মাপবে ১ ইঞ্চি আর ভর মাপবে ৬ টন।
বারো বছর তরণ দিলে আপনার বেগ হবে 0.99999999996c.
এই বারো বছরে পৃথিবীতে কেটে যাবে এক লক্ষ তেরো হাজার বছর।
আপনি মাত্র বারো বছরে পার করে আসবেন মিল্কি ওয়ের সীমা।
দুনিয়ার মানুষ আপনাকে ওজন করবে ৯০০০ টন, আর আপনার উচ্চতা মাপবে ব্যাকটেরিয়ার সমান।
কিন্তু ক্ষতি কি? ওই ফালতু দুনিয়ায় আর ফিরে যেতে হবে না।
এইভাবে তরণ দেওয়া সম্ভব না।
এক বছর তরণ দিতে সাড়া পৃথিবীর সব শক্তি খরচ হয়ে যাবে।
সত্যি সত্যি তরণ দেওয়া গেলে সেই একটা ব্যাপার হতো!
৩।
বেগ যোগের সূত্র থেকে আমরা দেখতে পাই, যার বেগ আলোর বেগের চেয়ে কম, সে কোনদিন আলোর বেগে পৌঁছতে পারবে না।
আলো বাদে।
সে ওই বেগ নিয়ে জন্মেছে।
তার বেগ বাড়বে না, কমবেও না।
আপনি যদি ফোটন হতেন আপনার জীবন কেমন হতো?
অসাধারণ, তাই তো?
ভুল।
ফোটনের সাপেক্ষে সময় স্থির।
পৃথিবী থেকে সূর্যে গেলে আমরা দেখি আলোর ৮ মিনিট সময় লাগছে।
তার নিজের কোন সময় লাগে না।
একটুও না।
তার নিজের কাছে সব দূরত্ব শূন্য।
আমার কাছে, ফোটন নিজে কোনরকম নড়াচড়া করছে না। একটুও হাত পা নাড়াচ্ছে না। শুধু ছুটে চলছে।
ফোটনের কাছে পুরা দুনিয়া একেবারে স্থির।
আরও ভালভাবে বললে, আপনি ফোটন হলে বাকি দুনিয়া থেকে কোন তথ্যই আপনার কাছে আসতো না।
তার চেয়ে বড় কথা, পুরা মহাবিশ্ব আপনার কাছে শুন্য দৈর্ঘ্যের হতো।
দূরত্ব শূন্য।
সময় শূন্য।
ফোটনের বয়স কখনও বাড়ে না।
বিগ ব্যাঙের সময় যে ফোটনটার জন্ম হয়েছিলো সে এখনো সেই শিশুটি আছে।
সময় শূন্য তাই আপনি ফোটন হলে আপনি কোনকিছু এক্সপেরিয়েন্স করতেন না।
চ্যাপ্টা, শূন্য সাইজের একটা ভয়ঙ্কর পৃথিবীতে আপনি হতেন পুরোপুরি অন্ধ এক চিরযৌবনা শিশু, বাইরের দুনিয়ার কাছে যে কিনা পুরোপুরি চ্যাপ্টা একটা মূর্তি!
আশরাফুল ইসলাম
খুব ভালো লাগল।
তবে ট্রেনের সাপেক্ষে ফোটনের বেগ মাপাটা ভুল হয়েছে মনে হয়। আমি জানি এটি একটি উদাহরণ তবুও বলছি।
বেগটা মনে হয় মাইনাস হয়ে ১ লক্ষ হবে।