কোয়ান্টাম ৪৩: ভরের জন্ম



কোয়ান্টাম ৪৩ 

ভরের জন্ম 

ভর কোথা থেকে আসে? 

আইনস্টাইনের E = mc2 থেকে নাকি হিগস ফিল্ড থেকে? 

ভর মানে কি পদার্থের পরিমাণ? 

ভর কি বাড়ে কমে? নাকি স্থির থাকে? 

ভর মানে কি শক্তি? 

আলোর কি ভর আছে? 

১। 

ভর কি মোট পদার্থের পরিমাপ? 

তাহলে পদার্থ আবার কি জিনিস? 

কোন জিনিসটা পদার্থ আর কোনটা অপদার্থ? 

ক্লিয়ার করি। 

ভর হচ্ছে জড়তার পরিমাপক। 

ভর এমন একটা জিনিস যেটা বস্তুর গতির পরিবর্তনে বাঁধা দেয়। 

একটা বস্তুর গতির পরিবর্তনে শুধু ভর বাঁধা দেয় না। বেগও বাঁধা দেয়। আমরা একসাথে বলি ভরবেগ।  গতির পরিবর্তন করতে হলে ভরবেগের পরিবর্তন করতে হয়। 

এইবার বলের কথায় আসি।

মহান বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন আজ থেকে চারশো বছর আগে বলের সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন। সংজ্ঞাটা হলো, বল হচ্ছে সময়ের সাপেক্ষে ভরবেগের পরিবর্তন। 

যদি বল হয় F, ভরবেগের পরিবর্তন হয় d(mv), এই পরিবর্তনে সময় লাগে dt, তাহলে, 

F = d(mv)/dt

নিউটন ধারণা করতেন, ভর স্থির থাকে। তাঁর মতে, m হচ্ছে ধ্রুব। তাহলে, বল হচ্ছে জাস্ট ভর * বেগের পরিবর্তন। 

F = m * dv/dt 

বেগের পরিবর্তনকে বলে তরণ। a = dv/dt 

আমরা লিখি, F = ma 

আইনস্টাইন দেখিয়েছেন, ভর পরিবর্তন হয়। তাহলে, ভরকে ধ্রুব ধরার কোন মানে হয় না। তাহলে, 

F = d(mv)/dt

কিন্তু 

F = ma না। 

ক্লিয়ার? 

২। 

শক্তি হচ্ছে বল * সরণ। 

বল প্রয়োগে যদি কোন বস্তুর সরণ হয়, তাহলে ওই বলকে সরণ দিয়ে গুন করে শক্তি পাওয়া যায়। 

একটা বস্তুর ভর ছিল mo. বেগ ছিল 0. সেটাতে সমভাবে বল দিলাম। ভরবেগের পরিবর্তন হলো। বেগ বেড়ে হলো v. এতে ওই বস্তুর সরণ হলো s. তরণ a = dv/dt. 

তাহলে, নিউটনের মতে, মোট প্রযুক্ত শক্তি হচ্ছে, 

E = m0 * a * s 

আদিবেগ 0 ধরে, আমরা পাই, 

v2 = 2 a s 

তারমানে, E = ½m0v2

এইবার আইনস্টাইনের কথায় আসি। 

স্পেশাল রিলেটিভিটি অনুযায়ী, ভর ধ্রুব না। 

একটা বস্তুর ভর ছিল m0. বেগ ছিল 0. 

সেটাতে বল দিলে ভর আর বেগ দুইই পরিবর্তন হয়। 

তার মানে হলো, t সময় ধরে ভরবেগ পরিবর্তন করে যখন আমি বেগ v করবো, ভর নিজেও m0 থেকে বেড়ে m হবে। 

ক্লিয়ার? 

আগে মনে করা হতো ভর স্থির থাকে, এখন ভরও পরিবর্তন হচ্ছে। 

কি পরিমাণ পরিবর্তন হবে সেটা লরেঞ্জ রূপান্তর থেকে পাওয়া যায়। সমীকরণ প্রতিপাদন আমি এখানে দিবো না, লিঙ্ক দিয়ে দিবো, দেখে নিতে পারেন। 

এইযে একটু করে বল দিলাম, একটু করে ভর আর বেগ দুইই পরিবর্তিত হলো, এই জন্য শক্তি লাগে 

E = (m – m0) c2 

এটা হচ্ছে গতিশক্তির মান। 

নিউটনের মতে, গতিশক্তির মান ছিল 

E = 1/2 m0 v2 

আইনস্টাইনের মতে, সেই একই গতিশক্তির মান 

E = (m – m0) c2 

আইনস্টাইন ঠিক বলেছিলেন। নিউটন ভুল করেছিলেন সামান্য। এই জিনিস হাজারও পরীক্ষায় প্রমাণিত। 

যদি বেগ v এর মান খুব কম হয় তাহলে 

E = (m – m0) c2 এর মান 1/2 m0 v2 এর প্রায় সমান হবে। তখন নিউটনের সূত্র ব্যবহার করা যাবে। 

ক্লিয়ার?? 

৩। 

বেগ জিনিসটা আপেক্ষিক। 

আমার সাপেক্ষে আপনার বেগ v . কিন্তু নিজের সাপেক্ষে আপনার বেগ হচ্ছে 0. 

তাই, বেগের জন্য যে ভর হচ্ছে সেটাও আপেক্ষিক। 

আপনার ভর আগে ছিল m0. আমার সাপেক্ষে v বেগ পাওয়ার কারণে আমার সাপেক্ষে আপনার ভর হয়েছে m. 

m হচ্ছে আপনার আপেক্ষিক ভর। 

এই আপেক্ষিক ভর বলগুলোর কাজে লাগবে। 

পৃথিবী আপনাকে টানার সময়, পৃথিবী সাপেক্ষে আপনার বেগ যদি v থাকে, তাহলে হিসাবে আসবে এই আপেক্ষিক ভর। 

আপনি নিজে নিজের ভর মাপতে গেলে কি মাপবেন বলেন তো? 

রাইট, আপনি মাপবেন, আপনার ভর m0. আগে যা ছিল তাই আছে। 

এই m0 কে বলে হচ্ছে রেস্ট মাস। 

আজকাল অনেক জায়গায় বিজ্ঞানীরা রেস্ট মাসকে m দিয়ে, আর আপেক্ষিক ভরকে gamma m দিয়ে প্রকাশ করেন। 

এই আর্টিকেলে ওই ঝামেলায় যাবো না। 

৪। 

তাহলে কি বুঝলাম? 

বুঝলাম যে, আগে ভর ছিল m0, শক্তি দেওয়ার পর ভর হয়েছে m. 

এইবার আসি, রিলেটিভ ভর কি কাজে লাগে সেটার কথায়। 

মনে করেন, আপনি একটা সিস্টেমের মোট ভর মাপছেন। 

ধরেন সিস্টেম টা একটা প্রোটন। 

একটা প্রোটনে তিনটা কোয়ার্ক থাকে। আর থাকে ভরশুন্য গ্লুয়ন। 

তিনটা কোয়ার্কের ভর আলাদাভাবে মাপলেন। তারপর যোগ দিলেন। 

এইটাই তো প্রোটনের মোট ভর নাকি?? 

এইবার যদি সত্যি সত্যি প্রোটনের ভর মাপেন, আপনি একটা ধাক্কা খাবেন। 

তিনটা কোয়ার্কের ভর একটা প্রোটনের মোট ভরের মাত্র ১% দিচ্ছে। 

আপনি ভুল করেছিলেন, কারন আপনি ভুলে গেছেন গ্লুয়নগুলো আপনার সাপেক্ষে গতিশীল। 

একটা প্রোটনের প্রায় সকল ভর আসে গ্লুওনের গতিশক্তি থেকে। 

একই কথা একটা নিউট্রনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 


এই নিয়ম শুধু প্রোটনে আর নিউট্রনে না। সব জায়গায় কাজ করে। 

খুবই সাধারণভাবে চিন্তা করেন। 

ভর হচ্ছে শক্তি। 

আপনাকে একটা বক্স দিলাম। বক্সে ১০টা মার্বেল আছে। 

মার্বেলগুলো স্থির থাকলে আপনি বক্সের যে ভর মাপতেন, মারবেল গুলোর গতিশক্তির কারণে তার চেয়ে ভর বেশি মাপবেন। 

ওই মারবেল আবার অণু পরমাণু দিয়ে তৈরি। 

একটা মারবেলের ভর মাপতে গেলে ওই অণু পরমাণুর ছোটাছুটি মাথায় আনতে হবে। 

আবার, একটা অণুর ভরের ক্ষেত্রে মাথায় আনতে হবে ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রনের গতির কথা। 

সবশেষে, প্রোটনের ভরের সময় মাথায় আসবে কোয়ার্কগুলোর গতিশক্তির কথা। 

৫। 

প্রতিটা ধাপে গতিশক্তির কারণে ভর বাড়বে। 

এখন ভর আছে m. 

আগে ছিল m0.

এই m0 আবার হয়েছে তার ভেতরকার কণাগুলোর গতিশক্তির জন্য। কণাগুলোর ভর আরও কম। 

আইনস্টাইন বলেছেন, 

এভাবে ভাঙতে ভাঙতে শেষ পর্যন্ত আমরা এমন জায়গায় পোঁছে যাবো যেখানে ভর শূন্য। 

একেবারে শূন্য ভর থেকে শুরু করে ভরবেগ বাড়িয়ে ভর m পরিমাণ আনতে যে পরিমাণ শক্তি লাগে সেটা হচ্ছে

E = mc2 


আইন্সটাইনের বিখ্যাত ভর শক্তির সমীকরণঃ এটা সব ক্ষেত্রে কাজ করে। 

এই সমীকরণকে ভাঙলে আমরা পাই এরকমঃ 

E2= (m0c2)2 + (pc)2

p হচ্ছে ভরবেগ একসাথে। 

অনেকে মনে করে E = mc2 পুর্নাঙ্গ না, আসল সমীকরণ নিচেরটা। 

এই ধারণা ভুল। 

বর্তমানে m0 এর বদলে m ব্যবহার করায় কনফিউশান হয়। 

দুইটাই, একই সমীকরণের দুই রূপ। 

এই পর্যন্ত কি ক্লিয়ার?? 

৫। 

আইনস্টাইন যে বলেছিলেন বাক্স খুলতে খুলতে একেবারে শূন্য ভরে পৌঁছব এই কথাটা ফোটনের ক্ষেত্রে চমৎকার ভাবে খাটে। 

ফোটনের রেস্ট মাস m0 = 0 

তার মানে, 

E2= (m0c2) + (pc)2

= (pc)2

ফোটন গতির কারণে ভরবেগ লাভ করে। তার রিলেটিভ ভর জন্মায়। সেই ভর থেকে শক্তিও আসে। 

বর্গমূল করে পাই, 

E = pc 

এই শক্তি মাপা হয় E = hf ব্যবহার করে। 

ফোটনের রেস্ট মাস নেই। 

কিন্তু আমি যদি এক বক্স ফোটন নেই। ওই বক্সের ভর হবে ফোটনশুন্য বক্সের চেয়ে অনেক বেশি। 

কারন ফোটনের রিলেটিভ ভর হিসাবে আসবে। 

৬। 

তার মানে, ভর মানে হচ্ছে শক্তির পরিমাণ। 

একটা নিউক্লিয়াস ভারী। ওইটার ভেতর নিউট্রন  প্রোটনগুলো ছুটাছুটি করছিলো। আকর্শন করছিলো। 

তাকে যদি আমি ভেঙ্গে ফেলি, তারা বাইরে এসে ছুটাছুটি করবে। 

কিছু আলোর কণাও জন্ম হবে। 

ভর ভেঙ্গে শক্তি হচ্ছে না। 

ভর মানে ছোটাছুটি। গতিশক্তি। 

ভর মানে আকর্শন। বিভবশক্তি। 

ভর মানে শক্তি। 

আপনি ভারী। আপনার ভুরি আছে। তার মানে, আপনার না হোক, আপনার ভেতরের কণাগুলোর অনেক শক্তি আছে। 

৭। 

আমরা দেখেছি ফোটনের রেস্ট মাস শূন্য। 

এটাই স্বাভাবিক। 

ফোটন মৌলিক কণা। 

এর ভেতর দৌড়াদৌড়ি করার কেউ নাই। 

প্রোটনের ভরের 99% আসে গ্লুয়নগুলর শক্তি থেকে। 

বাকি ১% আসে কোয়ার্কগুলর ভর থেকে। 

কিন্তু কোয়ার্ক তো মৌলিক কণা। 

এর ভেতরে দৌড়াবে কে? 

কোয়ার্ক, ইলেকট্রন এদের তো ভরশুন্য হওয়ার কথা। এরা ভর পাবে কোথা থেকে? 

উত্তর হচ্ছে, হিগস ফিল্ড। 

(চলবে)

5 thoughts on “কোয়ান্টাম ৪৩: ভরের জন্ম”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *