কোয়ান্টাম ৪১
কোয়ান্টাম মাল্টিভার্স ৪
১।
ধান ভানতে শিবের গান গাইতে শুরু করেছিলাম সেই চার পর্ব আগে। সকাল গড়িয়ে রাত হলো, পদ্মা মেঘনায় অনেক পানি গড়ালো, আমার গান আর শেষ হলো না।
শুরু করেছিলাম কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে, ঢুকে পরেছি মাল্টিভার্সে, আর বের হতে পারছি না 🙁
যাই হোক, দুই ধরণের মাল্টিভার্সের কথা বলেছি। এক হচ্ছে মহাবিশ্ব অসীম হলে, দুই ইনফ্লেশান চিরদিন চলতে থাকলে এখানে ওখানে বুদবুদের মতো ইউনিভার্স তৈরি হবে।
এইবার তিন আর চার নাম্বারগুলোর কথায় আছি।
প্রিয় পাঠক, মঞ্চে আসছে আমাদের সবার প্রিয়, সর্বজন শ্রদ্ধেয় স্ট্রিং থিওরি। সবাই একটু হাততালি দেই!
২।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কণা তরঙ্গের ডুয়ালিটি থেকে। একটা জিনিস কণা আর তরঙ্গ দুইই হতে পারে এটা চরম উদ্ভট, এই সিরিজের ৩৭টা চ্যাপ্টার শেষ করে ফেলেছি এই গল্প বলতে বলতে, সামনে হয়তো আরও বলবো।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স শুরুর দিকে কাজ করত কণাগুলোর শক্তি কি হবে, এখন কোথায় আছে, পরে কই যাবে এইসব নিয়ে। বাজারে তখন একদিকে চলছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স, আরেকদিকে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি।
জন্ম হলো পল ডিরাকের। খুবই স্বল্পভাষী, আধপাগল এই জিনিয়াসকে আইন্সটাইনের পর এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ফিজিসিস্ট মনে করা হয়। ডিরাক এসে স্পেশাল রিলেটিভিটির সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এক করে ফেললেন। ডিরাক দেখালেন কণাগুলো চিরন্তন না, সেগুলো তৈরি করা যায় আবার ধ্বংসও করা যায়। ওনলি ফিল্ড ইজ রিয়েল, ফিল্ড থেকে কণার জন্ম হয়। নতুন এই থিওরির নাম কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি (QFT) ।
ফ্র্যাঙ্কলি বলি, QFT সম্পর্কে আমার পড়াশুনা পপ সায়েন্স লেভেলের। তাই সংক্ষেপে বলি, পুরোপুরি যখন বুঝবো তখন আরও লেখা যাবে।
কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি ব্যাখ্যা করে ব্যাখ্যা করে প্রধান চারটা বলকে। QFT র প্রথম অংশের নাম QED, কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডিনামিক্স। QED এসেছে ডিরাক, ফাইনম্যান, সুইগনার এদের হাত ধরে। সে ব্যাখ্যা করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স কে। ফোটন আর ইলেকট্রনের প্রায় সকল ধর্ম QED দিয়ে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। QED কে বলা হয় বিজ্ঞানের সবচেয়ে নিখুঁত তত্ত্ব, দশমিকের পর অনেক ঘর পর্যন্ত এর ফলাফলগুলো পরীক্ষাগারে প্রমাণিত। একদিন এই জিনিস নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে। একটা মজার কথা বলি, QED মতে, আলো সরল পথে চলে না, সবচেয়ে ছোট পথেও চলে না, সে সবরকম পথে চলে!
QED র পরে আসলো ইলেক্ট্রোউইক থিওরি। সে কাজ করে উইক ফোর্স নিয়ে। উইক ফোর্সের জন্য একটা বড় পরমাণুতে ভাঙন ধরে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে বলগুলো বহন করে নানা ধরণের বোজোন কণা। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বলের কণা হচ্ছে ফোটন, আর উইক নিউক্লিয়ার বলের কণা হচ্ছে W আর Z বোজোন। ইলেক্ট্রোউইক থিওরি মতে, খুবই উঁচু শক্তিতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স আর উইক ফোর্স এক হয়ে যায়। W বোজোন, Z বোজোন আর ফোটন এক জিনিস হয়ে যায়। কণা কি জিনিস আমরা এখনও সত্যি সত্যি কেউ জানি না, প্রচণ্ড শক্তি দিলাম আর বাঘ বিড়াল শিয়াল এক হয়ে গেলো ভাবতেই জানি কেমন লাগে! ইলেক্ট্রোউইক ইউনিফিকেশানের জন্য সালাম, ওয়াইনবার্গ আর গ্লাসগো নোবেল প্রাইজ পান।
QFT র এর পরের অংশের নাম কোয়ান্টাম ক্রোমোডিনামিক্স, QCD। সে কাজ করে কোয়ার্ক নিয়ে। স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স নামের অস্বাভাবিক ক্ষমতাশালী বল তার রাজত্বের জায়গা। নিউক্লিয়াসের ভেতরে যে প্রোটন আর নিউট্রনগুলো থাকে এগুলো কেউ আসলে ইলেকট্রনের মতো মৌলিক কণা না। এরা তৈরি হয় তিনটা করে কোয়ার্ক করে। এই কোয়ার্কগুলোকে একসাথে ধরে রাখে গ্লুয়ন নামের বোজোন। QCD কাজ করে এই কোয়ার্ক গ্লুয়নগুলোকে নিয়ে, ব্যাখ্যা করে কিভাবে প্রোটনগুলো নিজেদের বিকর্ষণ সত্ত্বেও নিউক্লিয়াসে এক সাথে বসে থাকে। খুবই অস্বাভাবিক উচ্চ শক্তিতে ধারণা করা হয় কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন এক হয়ে যায়, কিন্তু সেটা এখনও প্রমাণ করা যায় নি।
এই তিন বলের থিওরিগুলো মিলে হচ্ছে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই জিনিসকে বলা যায় মানুষের জ্ঞানের চূড়ান্ত সীমা, ফিজিসিস্টদের সবচেয়ে আদরের সম্পদ। আমাদের সবচেয়ে নিখুঁত থিওরি।
৩।
স্ট্যান্ডার্ড মডেলে আছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স, উইক ফোর্স, আর স্ট্রং ফোর্স। বাকি থাকে গ্র্যাভিটি। চারটা বলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে রহস্যময় বল।
মহামনিষী আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে জেনারেল রিলেটিভিটি, GR. GR গ্র্যাভিটিকে ব্যাখ্যা করে স্পেস টাইমের বক্রতা হিসাবে। গ্র্যাভিটির সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোন সম্পর্ক নেই। গ্র্যাভিটি রাজত্ব করে অনেক বড় জায়গা জুড়ে, আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে ছোট ছোট কণা নিয়ে।
কিন্তু এমন অনেক ছোট জায়গা আছে যেখানে গ্র্যাভিটি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুইই লাগে। যেমন ব্ল্যাক হোলের গভীরে, বিগ ব্যাঙের শুরুতে। জেনারেল রিলেটিভিটি সেখানে অসীম মাণ নিয়ে আসে, ফিজিক্সের সূত্রগুলো ভেঙ্গে পরে। এই জায়গায় দরকার QFT এর চার নম্বর অংশ, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি।
এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণিত কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির তত্ত্ব নেই। আছে কয়েকটা হাইপোথিসিস। নিচে যা লিখবো সব অপ্রমাণিত, হাইপোথিসিস মাত্র।
এই অপ্রমাণিত হাইপোথিসিসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো স্ট্রিং থিওরি। গণিতের দিক দিয়ে থিওরি, ফিজিক্সের ক্ষেত্রে অপ্রমাণিত হাইপোথিসিস। বাঙ্গালি খুব পছন্দ করে।
৪।
৭০ এর দশক থেকে গ্র্যাভিটিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে মেলানোর চেষ্টায় জন্ম হয় স্ট্রিং থিওরির। খুবই অ্যাম্বিশাস থিওরি, তার ইচ্ছা ছিল থিওরি অভ এভ্রিথিং হওয়ার। সে আলোর বেগ এতো কেন ব্যাখ্যা করবে। ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের চার্জ সবকিছু সে ব্যাখ্যা করে ছাড়বে।
স্ট্রিং থিওরি মতে, মৌলিক কণাগুলো, ইলেকট্রন, কোয়ার্ক আসলে বিন্দু নয়, একেকটা স্ট্রিং, সুতার মতো জিনিস। এগুলো নানান ভাবে নানান দিকে কাঁপছে। কিভাবে কতো জোড়ে কাঁপছে সেখান থেকে বের হয়ে আসে ওই কণার ভর কি হবে, চার্জ কি হবে সবকিছু। স্ট্রিং অস্বাভাবিক ছোট জিনিস, কোন ধরণের পরীক্ষায় তাকে ডিটেক্ট করা সম্ভব না। এই স্ট্রিং একভাবে কাঁপলে আমরা মনে করি ইলেকট্রন, অন্যভাবে কাঁপলে মনে করি ফোটন।

ঝামেলা আরও আছে। এদের কাপাকাপি আমাদের পরিচিত 3D জগতে না। ৯টা ডাইমেনশনে এরা ছটফট করে কাঁপছে। আমরা ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণী, আমরা 3D এর বেশি কিছু কল্পনা করতে পারি না। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কণাগুলো নিজেরা যদি নয় মাত্রায় কাঁপে, আমরা কেন 3D? স্ট্রিং থিওরি বলে, বাকি মাত্রাগুলো খুব ছোট জায়গায় কুঁকড়ে আছে, বড় জগত থেকে তাদের টের পাওয়া যায় না।
দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হলো স্ট্রিং থিওরি। আসলো ভয়ঙ্কর সব গণিত। ব্রায়ান গ্রিনের এলিগ্যান্ট ইউনিভার্স বইয়ে আছে, অন্য থিওরিগুলোতে জটিল একটা সমীকরণ থাকে, সেটার একটা অ্যাপ্রক্সিমেট সমাধান করার চেষ্টা করি আমরা। স্ট্রিং থিওরি এত জটিল যে এর সমীকরণগুলো পর্যন্ত রেডি না। আমরা প্রথমে একটা অ্যাপ্রক্সিমেট সমীকরণ দাঁড়া করাই, তারপর সেটার অ্যাপ্রক্সিমেট সমাধান খুঁজি!
কিছুদিন পর স্ট্রিং থিওরির ৫টা আলাদা ভার্শন তৈরি হলো। স্ট্রিং থিয়োরিস্টদের মাথায় নতুন করে বাঁশ পড়ল। একে তো ছ্যারা ভ্যারা অবস্থা, তার উপর ৫টা স্ট্রিং থিওরি বের হয়ে গেছে। তো, এই অবস্থায় স্ট্রিং থিয়োরিস্টদের বাঁচাতে এগিয়ে আসলেন উইটেন নামের এক বিজ্ঞানী। তিনি দেখালেন, ৫টা স্ট্রিং থিওরি আসলে একটা বড় থিওরির নানান রূপ। এই বড় থিওরির নাম দেওয়া হলো M থিওরি। M মানে mother হতে পারে, মেমব্রেনও হতে পারে।
M থিওরি মতে, স্ট্রিংগুলো সব একমাত্রিক সুতার মতো না। এরা নানান মাত্রায় থাকতে পারে। এদের সাধারণ নাম দেওয়া হলো ব্রেইন (brane). membrane বা খোলস থেকে এই নাম।
এক মাত্রিক ব্রেইন হচ্ছে স্ট্রিং। সুতার মতো।
দুই মাত্রিক ব্রেইন হচ্ছে ২-ব্রেইন। ফলের খোসার মতো।
এরপর আসে ৩-ব্রেইন। ফলের মতো?
৪-ব্রেইন কিসের মতো?
যাই হোক, আগে ছিল সুতার মতো স্ট্রিং, এরপর আসলো নানান জাতের ব্রেইন। স্ট্রিং ছিল পিচ্চি পিচ্চি, ব্রেইন বানান সাইজের হলো। ছোট বড় মাঝারি, কতো কি!
৫।
বহুদিন আগে কার্ল স্যাগান তার কসমস বইয়ে ভয়ঙ্কর একটা ধারনার কথা বলে গেছেন। এমন কি হতে পারে, একটা ইলেকট্রন আসলে নিজে একটা ইউনিভার্স, ইলেকট্রনকে যদি ভাঙ্গি বের হয়ে আসবে আস্ত এক মহাবিশ্ব। সেখানে থাকবে চাঁদ তারা, গ্যালাক্সি, নেবুলা। থাকবে আরও অনেক ইলেকট্রন !
M থিওরি দাবী করে, আমাদের মহাবিশ্ব নিজেই একটা ব্রেইনের ভেতর ঘুরছে। অনেক অনেক ব্রেইন, বুদবুদের মতো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে একেকটা ইউনিভার্স। অগণিত বালির কণার মতো অগণিত ব্রেইন ইউনিভার্স। ব্রেইন ঘোলা করা ব্যাপার!

৬।
ঝামেলার এখানেই শেষ না।
দেখা গেলো, M থিওরির সমীকরণগুলোর সমাধান একটা না। দুই তিনটাও না।
10^500 টা।
একের পরে ৫০০টা শুন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যা তৈরি হয়, ততোগুলো।
প্রত্যেকটা সমাধান একেকটা আলাদা মহাবিশ্বের। একেকটায় একেক নিয়ম কানুন।
জন্ম হলো একটা না, দুইটা না, 10^500 টা প্যারালাল ইউনিভার্সের।
এই সমাধানগুলোর মধ্যে কোনটা আমাদের ইউনিভার্স নির্দেশ করে আমরা জানি না।

৭।
শুরু হয়েছিলো একটা থিওরির স্বপ্ন দিয়ে, যে উত্তর দিবে আলোর বেগ এতো কেন, ইলেকট্রনের ভর এতো কেন এই সব মৌলিক প্রশ্নের। শেষে জন্ম হলো এমন এক জিনিসের যে কিনা কোটি কোটি মহাবিশ্বের গল্প শোনায়, কিন্তু মৌলিক প্রশ্নগুলো প্রশ্নই রয়ে যায়।
ধরেন আপনি একজন বিজ্ঞানীকে খুঁজে বের করতে বললেন সূর্য কি দিয়ে তৈরি। সে অনেকদিন খেঁটে খুঁটে আপনার সামনে বিশাল লম্বা একটা লিস্ট নিয়ে আসলো, সূর্য মাটি দিয়ে তৈরি হলে কি হবে, পানি দিয়ে তৈরি হলে কি হবে হ্যান ত্যান।
আপনি খেপে যেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এসব পরে হবে, আকাশে যে সূর্যটা জ্বলছে ওইটা কি দিয়ে তৈরি?
বিজ্ঞানী আরও খেপে গিয়ে বলল, ওইটা জানি না। কিন্তু সব ধরণের প্যারালাল সূর্য আছে!!
৮।
স্ট্রিং থিওরির এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ নেই।
স্ট্রিং থিওরির বিকল্প থিওরি দাঁড় হচ্ছে। সেগুলোরও প্রমাম নেই এখনও।
স্ট্রিং থিওরি নিজেও এখনও কমপ্লিট না। কমপ্লিট হলে হাজার হাজার ইউনিভার্সের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যেতে পারে।
অনেকগুলো মাত্রা, স্ট্রিং এর কাঁপা কাঁপি এগুলোর কোনটারই কোন প্রমাণ নেই।
আগের পর্বগুলো: https://nayeem.science/category/physics/quantum-mechanics/
(চলবে)