শিকার ২
(কল্পবিজ্ঞানঃ রহিমার মা/কুয়ার সিকোয়েল)
পূর্বকথা
আকবর সাহেব অজ্ঞাতনামা লাশটার খবর শুনেছেন। শোকে ক্রোধে আতঙ্কে তিনি সবুজ হয়ে গেছেন। তাঁর হাতটা থরথর করে কাঁপছে। এই অবস্থাতেও তিনি গাড়ি ড্রাইভ করছেন।
তিনি থানায় চলেছেন।
ঈদের দুইদিন বাকি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাড়িটা জোরে টান দিলেন।
মানুষ খুব আশাবাদী প্রাণী।
ক্যান্সারের শেষ মুহূর্তেও মানুষ আশা করে কোন একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটবে, বাংলা সিনেমার মতো নাটকীয় একটা ঔষধ আবিষ্কার হবে, সৃষ্টিকর্তা হয়তো নিজ হাতে তাকে রক্ষা করবেন!
আকবর সাহেবও মনে মনে দোয়া করছেন, আল্লাহ, কোনভাবে কি সম্ভব যে লাশটা পাওয়া গেছে সেটা রুদ্রের না? কোনভাবে কি সম্ভব ছেলের মরামুখটা আজকে দেখতে হবে না?
মালিবাগ মোড়টা ক্রস করার আগেই আকবর সাহেবের দোয়া কবুল হলো। একটা পাচটনী ট্রাক ছুটে এসে ধাক্কা লাগাল গাড়ির ডান পাশে।
ছেলের মরামুখ আকবর সাহেবের দেখতে হলো না আর।
১।
আস্তে আস্তে রাত নেমেছে। কিট কিট, ঝিক ঝিক, ছ্যাত ছ্যাত – একটানা শব্দে ছেয়ে গেছে বনভূমি। দূরে ঝোপে ঝাড়ে আলোর মেলা বসেছে – জোনাক জ্বলছে পাহাড়ি জঙ্গলে।
ভাইপো ছেলেটার বয়স মাত্র ১৬ বছর। বনে বাদারে শিকার করে মানুষ, তাছাড়া তাঁরও একটা ভালো সঙ্গী দরকার, নাহলে ছেলেটাকে সাথে আনতেন না। ঈশান কোনে মেঘ জমেছে, লক্ষণ ভালো না। মোটা চাদরটা তাঁর নিজের যতটা দরকার, তারচেয়ে বেশি দরকার তাঁর ভাইপোর।
অর্বাচীন চাকমা চাদরটা ভাইপোর দিকে বারিয়ে দিতে গিয়ে নিচে তাকালেন। আলো হাতে কেউ একজন আসছে।
২।
ফাদার রোজারিও জঙ্গল থেকে বের হয়ে এলেন।
– সেলাম সাহেব।
– সেলাম। কি মনে করে ফাদার?
– আপনাদের জন্য সামান্য খাবার নিয়ে আসলাম। রাত্রি জাগবেন, বারবার করে বললাম, জঙ্গল ভালো না। আমার কথা তো শুনলেন না।
– অনেক ধন্যবাদ ফাদার। অনেক শুক্রিয়া। তা ফাদার, জঙ্গল যে ভালো না আপনি তো আমার চেয়ে ভালো করে জানেন। আপনি আসলেন কোন সাহসে?
ফাদার রোজারিও জবাব দিতে এক মুহূর্ত সময় নিলেন। অর্বাচীন চাকমার মনে হলো ফাদারের চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠল।
ফাদার শান্ত গলায় বললেন, আমার সাথে ঈশ্বর আছে সাহেব। আমার কোন ভয় নেই। আশা করি আপনার সাথেও তিনি থাকবেন।
৩।
রোজারিও চলে গেলেন। অর্বাচীন চাকমা তাঁর দেওয়া ঝুলিটা খুলে দেখলেন।
টিফিন বাটিতে ভাত আর মাংস। সাথে একটা ফ্লাস্ক। ভেতরে গরম গরম হরলিক্স।
অর্বাচীন চাকমা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। লোকটাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। একবার মনে হয় এই লোক একেবারে মাটির মানুষ, ঈশ্বরের সেবা করার জন্য মুখিয়ে আছেন। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানি গোপন জিনিস পেটে চেপে রেখে ঘুরছেন, ঠোঁটের কোণে খেলা করছে কুটিল হাসি। রোজারিও সাহেবের ট্রেড মার্ক, বেলি ফুল মার্কা হরলিক্স – বাচ্চাদের সেই পছন্দ।
সামনে দীর্ঘ রাত। মেঘটা বড় হচ্ছে, বাতাসের বেগ বাড়ছে। খাবারটা ভাগ করে খেয়ে ফেলা দরকার। হরলিক্সে ভাগ বসানো ঠিক হবে না, এই জিনিস তাঁর চেয়ে তাঁর ভাইপোর বেশি দরকার। আজ রাতে ঘুমালে চলবে না।
৪।
রাত বাড়ল।
বাড়ল বাতাসের গতি।
বহু দুরে হুক্কা হুয়া শব্দে ডেকে উঠল শিয়ালের পাল।
মেঘটা ঈশান কোণ থেকে আরও কাছাকাছি আসলো।
বিদ্যুৎ চমকাল কয়েকবার।
জঙ্গলের চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা। বিদ্যুৎ চমকের শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে বেরাল বন জুরে।
অর্বাচীন চাকমা কি মনে করে আকাশের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে কি একটা অশুভ অনুভূতি ছেয়ে ফেলল তাঁর মন।
তাঁর কেন জানি মনে হলো, মাথার উপরের ওই মেঘটা স্বাভাবিক মেঘ না।
কিছু একটা আছে তার আড়ালে। ভয়ঙ্কর কিছু একটা।
অর্বাচীন চাকমার মনে হলো সব ছেড়ে ছুড়ে এই মুহূর্তে বাসায় চলে যাওয়া উচিত। গভীর বনের মাঝে অন্ধকার নিশুতি রাতে ছেলের লাশের উপর বসে তাঁর নিজেকে খুব অসহায় লাগলো।

৫।
বহু দূরের এক গোপন ল্যাবরেটরি।
কেমিক্যালটার আরেক ব্যাচ রেডি হয়েছে। এর পরের কাজ মিক্সিং।
এই অংশটাতে এসে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আলবার্তোর হাত কাঁপতে থাকে।
খবরগুলো আগে গোপন ছিল। বেশিদিন গোপন রাখা যায় নি। এক মুখ আরেক মুখ করে ছড়িয়েছে।
শেষে প্রফেসর স্টেইন ব্রেক নিজে এসে বুঝিয়েছেন।
তোমার হাতে যদি দুইটা বাটন থাকে, একটা টিপলে সমস্ত মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, আরেকটা টিপলে তোমার অপিরিচিত, তৃতীয় বিশ্বের কয়েকটা গরীব দুঃখী ছেলে মারা যাবে, তুমি কোন বাটনটা টিপবা? আর ব্যাপারটা তো বেশিদিন না। ডিভাইসটা তৈরি হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলবার্তো কাঁপা কাঁপা হাতে মিক্সিংএর কাজ চালাতে থাকে।
Everything is being done for the greater good.
ক্ষমা কর প্রভু।
(চলবে)