শিকার ১
(কল্পবিজ্ঞান)
(রহিমার মা কাহিনীর সিকোয়েল)
পূর্বকথা
ফাদার সিল্ভেস্টার রোজারিওর মনে আজ খুব শান্তি। এই গহীন জঙ্গলের এই অসহায় আদিবাসীদের কাছে তিনি ঈশ্বরের কৃপা পৌঁছে দিতে পেরেছেন। অপুষ্ট, লিকলিকে আদিবাসী বাচ্চাগুলো তাঁর দেওয়া হরলিক্স খেয়ে কেমন মোটাতাজা হচ্ছে। রোজারিওর চোখদুটো আনন্দে চিকচিক করছে।
রোজারিও আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে মেঘ জমেছে। বাতাস হচ্ছে এলোমেলো।
আজ রাতে বৃষ্টি নামবে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
সঙ্গে নামবেন ঈশ্বর স্বয়ং।
রোজারিওর আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে। ফালতু বস্তির ছেলেগুলো শেষ পর্যন্ত কাজে লাগছে!
১।
অর্বাচীন চাকমার বয়স হয়েছে অনেক। আগের মত সেই শক্তি হয়তো আর নেই। গায়ের মাংসল পেশি আগের মত হয়তো ফুলে উঠে না।
বুকের সাহস কিন্তু আগের মতোই আছে।
এই মুহূর্তে তার চোখে আগুণ জ্বলছে। প্রতিহিংসার আগুণ।
এই জঙ্গলে বাঘ দেখা গেছে দশ বছর পরে। বাঘ এসেই মানুষ মেরেছে দুইটা।
পাশের বাড়ির ছেলেটার বয়স হয়েছিল ১০-১১। কোন কথা শুনত না, স্কুল থেকে এসে এক মুহূর্ত বাড়ি থাকত না। তার সাথে সাথে মিশে তার ছেলেটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ১০ বছর বয়স, এখনি হাতের টিপ সেই। গুলতি দিয়ে উড়ন্ত পাখি পর্যন্ত শিকার করে ফেলত।
কালকে বাইরে এত ঝড়বৃষ্টি, বারবার করে ছেলেকে বললেন বাসায় থাকতে, ছেলে কথা শুনল না। ঝড়ে পাখি পরে অনেক, শিকারের এই তো সময়। হাতে গুলতি নিয়ে বের হয়ে গেল।
সারারাত বাড়ি ফিরল না।
অর্বাচীন বাবু শেষে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলেন। ছেলের নাম নিয়ে বারবার ডাকলেন। সাড়া মিলল না।
পরদিন ভোরবেলা ছেলের খবর আনল কাঠুরের দল। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দুরে ছেলের লাশ পাওয়া গেছে। আর তার বন্ধুর লাশও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
পরদিন শান্ত শিষ্ট পাহাড়ি গ্রামটাতে নরক নামল। ছেলের মা কানতে কানতে দুইবার অজ্ঞান হয়ে গেল। পাশের বাড়ি থেকেও ভেসে আসল তীব্র হাহাকার।
ফাদার রোজারিও আসলেন সান্তনা দিতে, লাভ হলো না।
ছেলের মা কএদতেই থাকল।
অর্বাচীন চাকমা একবাররও কাঁদেন নি। ছেলের লাশ দেখার পর থেকে তিনি পাথর হয়ে গেছেন।
কি নৃশংস, নিষ্ঠুর খুন। শরীরের অর্ধেকের মাংস একেবারে চেঁচে নিয়ে গেছে। শরীর প্রায় রক্তশূন্য।
এখন নাহয় বাঘ কমে গেছে, তার যুবক বয়সে এ তল্লাটে বাঘ ছিল অনেক। বাঘে মারা লাশ তার কাছে অপরিচিত নয়।
এই অদ্ভুত নৃশংস হত্যাকাণ্ড তিনি কোনদিন দেখেন নি।
মনে হচ্ছে ধারানো ছুড়ি দিয়ে শরীরের অর্ধেকের মাংস একেবারে কেটে নিইয়েছে কেউ।
মন বলছে, এই কাজ বাঘ করে নি। অন্য কিছু করেছে।
আবার লাশের পাশের বাঘের পায়ের ছাপ, গায়ে থাবার দাগ বলছে, বাঘই এই কাজ করেছে।

অর্বাচীন চাকমা বুকে পাথর বাধলেন। ছেলের মার সমস্ত কান্নাকাটি উপেক্ষা করলেন। বাড়িতে লাশ আনতে দিলেন না।
যেখানে ছেলের লাশ পাওয়া গেছে, লাশ থাকবে একেবারে সেই জায়গায়। কোন চিহ্ন সরানো যাবে না।
আজ রাতে ছেলের মাংস খেতে আবার বাঘ আসবে। বাঘকে তখন হত্যা করতে হবে।
আজকের রাত প্রতিশোধের রাত।
আজ রাতে অর্বাচীন চাকমার হাতে আবার আগুন জ্বলবে অনেকদিন পর।
অর্বাচীন চাকমা বন্দুক হাতে নিলেন। অনেকদিন পর যত্ন করে ব্যারেল পরিষ্কার করলেন।
.450 ক্যালিবারের এই রাইফেলটা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। হাতি পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারে।
অর্বাচীন চাকমার হাতে নিষ্ঠুর হাসি ফুটলো। তাঁকে দেখতে অনেকটা উন্মাদের মতো লাগলো।
২।
গাছটা প্রায় একশো ফুট উঁচু, অনেক ঝাপুর ঝুপুর। বিরাট বিরাট পাতাগুলো রহস্যময় অন্ধকার তৈরি করেছে মাথার উপর।
অর্বাচীন চাকমা তাঁর ভাইপোকে সাথে নিয়ে প্রায় ৩০ ফুট উঁচুতে একটা ডাল বেঁছে নিয়ে মাচার মতো বানালেন। এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি হাতে নিয়ে মাচায় উঠলেন। আজ রাতে ঘুমালে চলবে না। স্নায়ু একেবারে টনটনা করে রাখতে হবে। গাছের নিচে ছেলের আধখাওয়া লাশটায় মাছি বসছে। আর একটু কষ্ট কর বাবা, অর্বাচীন চাকমা নিজেকেই যেন বুঝালেন।
৩।
সন্ধ্যার জঙ্গল শব্দে মুখর। কুকরুক কুক কক বলে বন মোরগের দল হাউকাউ করতে করতে বাসায় ঢুকল। হনুমানের পাল হুপ হুপ শব্দ করে বড় বড় গাছের মগডালে কিছুক্ষণ লাফঝাঁপ করল। দুইচারটা দুষ্টু হনুমানের ছানা বাসায় আসতে চাচ্ছিল না, মা তাদের লেজ ধরে টেনে জোর করে বাসায় ফেরাল। তাঁর ছেলেটাকেও যদি এভাবে ধরে বেঁধে বাসায় রাখতে পারতেন!
পাহাড়ি বনে সন্ধ্যা নামে হুট করে। লাল বলের মত সূর্যটা হটাত টুপ করে একটা পাহাড়ের পেছনে মুখ লুকাল, আর ঝুপ করে কালো একটা চাদর নামলো অন্ধকারের।
রাত নামলো ঝুপ্সির বনে। সাইরেন ঝিঁঝিঁরা একটানা চিৎকার করে জানিয়ে দিলো তার আগমন বার্তা। দূরে অনেক দূরে সজারুর ঝমঝম শব্দ শোনা গেল। নাইটজার পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকারে হঠাত কেঁপে উঠলো বনভূমি। কাছে কোথাও কি জানি একটা লাফ দিলো একডাল থেকে অন্য ডালে।
হঠাত রক্ত হিম করা একটা গর্জনে কেঁপে উঠল চারপাশ। অর্বাচীনের ভাইপোর মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেলো। অর্বাচীন চাকমা তার বুকে হাত রেখে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
আজকের রাত তারাহীন, আর চাঁদহীন। আজকের রাত শিকার আর শিকারির।
আজকের রাত রহস্যের!
৪।
আজকের রাতে আরও একজন না ঘুমিয়ে আছেন, তিনি ফাদার রোজারিও। তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।
আজ রাতে আবার বৃষ্টি নামবে।
বৃষ্টির সাথে নামবেন ঈশ্বর!
(চলবে)
Naeym Saruar Opu
গল্পটা খুব ভালো লাগছে।রেটিং দেওয়ার সিস্টেম থাকলে ৫/৫ দিতাম।আপনার এই গল্পটা ফেইসবুকে পোস্ট করছিলেন কিন্তু মিস করছি তাই আবার তিনটা গল্প প্রথম থেকে পড়তাছি সিকুয়েল গল্পসহ।
Nayeem
🙂
prema
আপনার সব লেখাই খুবই ভাল।