রহিমার মা ২



রহিমার মা – ২
(কল্পবিজ্ঞান)

১।
আকবর সাহেব হরলিক্সটা খুলে একটু মুখে দিলেন। অপূর্ব স্বাদ। সাথে বেলি ফুলের একটা গন্ধ।
তাঁর কেমন জানি একটা খটকা লাগলো। এই ছেলেকে খাওয়ানো ঠিক হবে কিনা ভাবতে হবে। আগে ল্যাব টেস্টে পাঠানো দরকার।

পাঁচ সাত ভাবছেন, রুমে শাহানা এসে হাজির। তার চোখ মুখ কাঁদতে কাঁদতে ফুলে গেছে। রুদ্র নাকি ২ দিন ধরে কিচ্ছু মুখে দেয় নি। এক ফোটা ভাতও না।
আকবর সাহেব কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পেলেন না। শাহানা হাত থেকে ছোঁ মেরে হরলিক্সের কৌটাটা নিয়ে গেলো।
আকবর সাহেব চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকলেন। রুদ্রকে খুব শিগ্রি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। হরলিক্সটাও ল্যাব টেস্টে পাঠানো খুব দরকার।

২।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে খোঁজ নিয়ে লাভ হলো না। হাটহাজারি থেকে হরলিক্সের কৌটাটা রহিমার মার পক্ষ থেকে পার্সেল করেছে অল্পবয়সী একটা ছেলে। এবারও ভুল ফোন নাম্বার দেওয়া হয়েছে।

হরলিক্সের স্যাম্পল ল্যাব টেস্টে পাঠানো হয়েছিলো। ডাক্তাররা এখন পর্যন্ত ক্ষতিকর কিছু খুঁজে পান নি, বরং বেশ পুষ্টিকর জিনিস। তারপরও তাঁরা অপরিচিত কিছু কেমিক্যাল খুঁজে পেয়েছেন, আরও কিছু পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন। আপাতত হরলিক্সটা না খাওয়ালেই ভালো হয় বলে মত দিয়েছেন।

রুদ্রর মধ্যে কেমন জানি একটা পরিবর্তন এসেছে। হাসিখুশি ছেলেটা কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে। এই কয়দিকে কি আরও একটু লম্বা হয়েছে? শরীরে আবার রং ফিরেছে তার, নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করছে, স্বাস্থ্যও হয়েছে বেশ। আসলে স্বাস্থ্যটা একটু বেশিই ভালো বলতে হবে, ঠিক স্বাস্থ্যবান না, কেমন জানি থলথলে একটা ভাব চলে এসেছে। কিসের সাথে জানি মিল আছে, ঠিক বুঝতে পারছেন না।  রুদ্রকে খুব তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার। কিছু একটা ঠিক নেই।

৩।
পরের কটা দিন আবার অনেক ব্যাস্ততার মধ্যে কাটল আকবর সাহেবের। রুদ্রকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো না। এই এলাকায় নতুন এসেছেন, শাহানা রাস্তাঘাট খুব একটা চেনে না, একা ছেলেকে নিয়ে বের হতে পারবে না বলে দিলো। শাহানা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝছে না, রুদ্র খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কোন সমস্যা টের পাচ্ছে না।

এই সময় সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে তৃতীয় চিঠিটা আসলো। সাথে হরলিক্স। রহিমার মা এবার চিঠি লিখেছে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থেকে। আগের মতোই, হাতের লেখা আবারও আলাদা।

“বাজান,
তোমরা তো ভালোই আছো, কষ্টে আছি আমরা। এলাকায় দুর্ভিক্ষ লেগেছে। রহিমা না খেতে খেতে শুকিয়ে গেছে। কি করবো বল বাবা, গরুর খাবার হলো ঘাস, আর মানুষের খাবার হলো গরু, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
খুব ক্ষুধা বাবা, খুব ক্ষুধা। আমাদের অনেকেই তোমাদের ওদিকে চলে আসছে। আমিও রহিমাকে নিয়ে চলে আসবো।
বহু দূরের পথ বাজান। খুব কষ্ট।
খাবার রেডি রেখো।
ইতি, রহিমার মা। ”

আকবর সাহেব চিঠিটা পড়ে কেমন জানি একটা ধাক্কা খেলেন। আগের হরলিক্সটা শেষ হয় নি এখনো, এটা লুকিয়ে ফেলতে হবে। কালকে দরকার হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রুদ্রকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। চিঠির কথাগুলো এখনো তাঁর চোখে ভাসছে।

“গরুর খাবার হলো ঘাস, আর মানুষের খাবার হলো গরু, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।”

কিছু একটা ঠিক নেই। রহিমার মা নিজে মেয়েকে খাওয়াতে পারছে না, তাঁর ছেলের জন্য হরলিক্স পাঠাচ্ছে।
Something is Definitely Wrong.

৪।
আকবর সাহেব বেশিক্ষণ চিন্তা করতে পারলেন না। অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, ছুটতে হবে। যাওয়ার আগে শাহানাকে বলে গেলেন রুদ্রকে চোখে চোখে রাখতে। মেয়েটা বুঝল কিনা কে জানে। আকবর সাহেবের সাথে শাহানার বিশ বছরের গ্যাপ, মেন্টালিটি ঠিক ম্যাচ খায় না।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, মুরগির মাংস আর ডাল দিয়ে, তখন বুঝতে পারলেন রুদ্রের শরীরটা কিসের মতো হয়েছে। ফার্মের মুরগির মতো।

একটু পর শাহানার ফোন আসলো। রুদ্রকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শাহানা গোসল করতে গিয়েছিলো, রুদ্র দরজা খুলে বের হয়ে গেছে। আশেপাশে সবাই খোঁজ লাগিয়েছে, পুলিশকেও ফোন দেওয়া হয়েছে।
আকবর সাহেব কাঁপতে কাঁপতে তৎক্ষণাৎ বাসায় রওনা দিলেন।

৫।
পরিশিষ্ট
অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে মিজান ঘুম থেকে উঠলো। বহু দূরের এক পৃথিবী থেকে কেউ একজন যোগাযোগের চেষ্টা করছে তার সাথে। সে দুনিয়াবাসির কাছে উপহার পাঠাতে চায়, উন্নত জাতের খাবার, পরে আরও অনেক কিছু।
মিজানের বিছানার পাশে একটা হরলিক্সের কৌটা। এই হরলিক্সের কৌটাটা তাকে একজনের কাছে পাঠাতে হবে। পাঠানো খুব দরকার। সাথে একটা চিঠিও লিখতে হবে।
মিজান কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সে ঘুম থেকে উঠেই চিঠি লিখতে বসল।

আশেপাশে মিজানের মা চিল্লাচিল্লি করছে, মিজান, আর কতো ঘুমাবি? কলেজে যাবি না? আজকে নিউজ দেখেছিস? মহাখালি রেল গেটের কাছে রেল লাইনের ধারে একটা ছেলের লাশ পাওয়া গেছে। বীভৎস দৃশ্য, কেউ নাকি শরীর থেকে হাড় মাংস কেটে খেয়ে নিয়েছে, পড়ে আছে কঙ্কালটা।
কই গেলি মিজান? দরজা খোল…

দরজা খোলার টাইম নাই, চিঠিটা শেষ করতে হবে। দরদ দিয়ে, মমতা ঢেলে একটা চিঠি লিখতে হবে। হরলিক্সটা খাওয়ানো খুব দরকার। খুব কনভিন্সিং চিঠি হতে হবে।

শেষে নাম লিখতে হবে, রহিমার মা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *