কুয়া
কল্পবিজ্ঞান
১।
জমিদার মহেন্দ্র বাহাদুর গ্রামটা দখল করেছেন। তাঁর রাজ্যের সীমানা আরও ২০০ বিঘা বাড়ল। আজ তিনি বেজায় খুশি।
আগের বৃদ্ধ অথর্ব জমিদার হালিশ চন্দ্রকে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে। বেগম আর রাজকন্যা আপাতত লকারে আছে, সুবিধামত ব্যাবহার করা যাবে।
আজকে প্রজারা সব খাজনা দিতে এসেছে। জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে আছে। মহেন্দ্রবাবু ঘুরে ঘুরে খাজনা নেওয়া দেখছেন। যারা খাজনা দিতে পারছে না পেয়াদা তাদের চাবুক মারছে। চাবুকের ভয়ে সবার থলি থেকেই টাকা বের হচ্ছে।
মোহরের ঠনঠন শব্দ সেই লাগে মহেন্দ্রবাবুর।
২।
এই গ্রামের মন্দিরটা সেই। দেয়াল ভর্তি কারুকাজ। নানান জাতের সাপের ছবি গায়ে। যে বানিয়েছে সে খুব ভালো আর্ট বুঝে।
মহেন্দ্র বাবু পুজো দিতে চলেছেন। সাথে আছে তাঁর পাইক পেয়াদা আর খাজাঞ্চি। অনেক তো টাকা কামাই হলো, এবার দেব তুষ্টিও দরকার!
মহেন্দ্র বাবু উদার মানুষ। দেব তুষ্টির ব্যাবস্থা ভালভাবেই করলেন। তারপর মন্দির ঘুরতে বের হলেন। মন্দিরের ঠিক মাঝ বরাবর উঠানে বিরাট একটা কুয়া। কুয়ার মুখ লোহার পাত লাগিয়ে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করা।
মহেন্দ্রবাবু কৌতূহলী হলেন। পুরোহিতকে ডেকে পাঠালেন। কাঁপতে কাঁপতে পুরোহিত এলো।
ও কুয়ার ইতিহাস জানি না বাবু, ও কুয়া হাজার বছরের পুরানা। লোকে বলে, ১০ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাত দিয়ে কুয়ার মুখ বন্ধ করা। কে বন্ধ করেছে জানিনা বাবু, কিন্তু মন্দিরের প্রাচীন পুঁথিতে বারবার করে লেখা আছে, ও কুয়া খুলতে নেই, খুললে মহা অঘটন ঘটবে।
মহেন্দ্র বাবুর বিরক্ত লাগলো। অঘটন ঘটবে মানে? তিনি থাকতে আর কে আছে অঘটন ঘটানোর? যাই হোক, বেলা পড়ে এসেছে, আজকের মতো বিদায় নেওয়া উচিত। মন্দিদের প্রাচীন পুঁথি সব প্রাসাদে পাঠিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিলেন।
আকাশে তখন মেঘ করেছে, ঝড় আসবে বলে। বিদ্যুতের শব্দ লকলক করলো, কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। মহেন্দ্র বাবু যাওয়ার জন্য রেডি হলেন।
হঠাত মনে হলো, প্রাচীন কুয়াটার পুরু ইস্পাতের পাতের ভেতর থেকে কেমন জানি একটা গুমগুম শব্দ ভেসে আসলো।

৩।
পুঁথিগুলো প্রাসাদে এসেছে। মহেন্দ্র বাবু পাতা উল্টাচ্ছেন।
দুর্বোধ্য প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা। পড়ে কি বলছে বোঝা দায়। নানা ধরনের আজগুবি ছবি আর নকশা।
কালকে রাজ পণ্ডিতকে লাগাতে হবে। এই জিনিস ডিকোড করা তাঁর সাধে কুলাবে না।
হাল ছেড়ে দিয়ে রেখে দিচ্ছিলেন, হঠাত কয়েকটা পেইজে এসে তাঁর চোখ আটকে যায়।
পেইজের হিজিবিজি অক্ষরের ফাকে কেউ একজন খুব ছোট ছোট অক্ষরে কিছু একটা লিখেছে। খেয়াল করলে বোঝা যায়, ভাষাটা বাংলা।
এখনকার বাংলা না, কয়েকশো বছর আগের বাংলা। তবু বাংলা তো!
মহেন্দ্র বাবু অতসী কাঁচ নিয়ে বসলেন। প্রাসাদে ধিকি ধিকি মশালের আলো জ্বলছে। বাইরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।
ওই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে মশালের আলোয় কেউ তাকালে দেখতে পেত মহেন্দ্রবাবুর চোখ চকচক করছে।
কয়েকটা শব্দের মানে তিনি বুঝতে পেরেছেন।
“গুপ্তধন”, “সাপের মণি” আর “সর্পদেবীর অভিশাপ”।
৪।
রাতের অন্ধকারে মন্দির দখল করা হলো।
কামান আর গোলাবারুদের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল গ্রামবাসী। তবে মন্দিরের কাছে ঘেষতে পারল না। সিপাই গিজগিজ করছে চারপাশে।
১০ ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের তক্তা বিস্ফোরকের কাছে হার মানল। বের হয়ে আসলো কুয়ার কালো অন্ধকার মুখ।
পুরোহিত বাবু অনেক অনুনয় বিনয় করে বাঁধা দিতে চাইলেন, লাভ হলো না।
ভোরের আলো ফুটতে কুয়ার মুখ মানুষ নামার মতো চওড়া হলো। দেখা গেল কুয়ার দুই পাশে দুইটা মই নেমে গেছে বহু বহুদূর, ভূগর্ভের অতলে।
জমিদারবাবুর আদেশে তাঁর দুই বিশ্বস্ত অনুচর কামরান আর হিন্দাল কুয়ায় নামার জন্য রেডি হলো।
পরনে তাদের লোহার চেইনের বর্ম।
কামরান হাতে থাকল মশাল, আর একজোড়া গাইতি, পিঠে একগাছি দড়ি।
হিন্দাল সাথে রাখল অস্ত্রশস্ত্র, সাপ মারার জন্য যা যা লাগে।
জমিদারবাবুর জন্য সাপের মণি আনতে পারলে তারাও পাবে টাকার ভাগ।
৫।
হিন্দাল আর কামরান ফিরল অনেক পরে, একেবারে শেষ বিকালে। হাতে তাদের চকচক করছে দুই দুইটা সাদা রত্ন। শেষ বিকালের সূর্যের আলো রক্তের মতো ঝলমল করছে তাতে।
তারা মহারাজকে শোনালো রোমহর্ষক এক গল্প। মাটির বহু বহু নিচে আছে সাত রাজার ধন মানিক। পাথরের গায়ে গায়ে লেগে চকমক করছে রং বেরঙের ধন রত্ন। পাথরের গায়ে সেগুলো এমন গভীরভাবে লেগে আছে, একটা রত্ন বের করতেই খবর হয়ে যায়।
তার উপর আছে সাপ, যক্ষের মতো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে ধনরত্ন। এই বিশাল রত্ন ভাণ্ডার তুলে আনতে হলে আরও অনেক লোক দরকার।
মহেন্দ্র বাবু চিন্তায় পরে গেলেন। বেশি লোক হলে জানাজানি হবে, লোকজনকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না তখন। সব বুঝে শুনে নিজের একান্ত বিশ্বস্ত দশ জনকে লাগালেন ধনরত্ন উদ্ধার করতে।
ফেরার জন্য রেডি হচ্ছেন, হঠাত আবার কুয়ার ভেতর থেকে গুমগুম করে একটা শব্দ ভেসে এলো। শব্দের সাথে কেমন জানি একটা বোটকা গন্ধ। মহেন্দ্রবাবু রত্নের চিন্তায় বিভোর, ঠিক খেয়াল করলেন না।
৬।
আজকে মহেন্দ্রবাবু নিজে চলেছেন সাত রাজার ধনকে দেখতে।
গায়ে তাঁর পুরু বর্ম, হাতে পায়ে সাপ নিরোধক তেল। আস্তিনে ছোরা, এক হাতে মশাল।
দুই নাম্বার দল ফেরত আসার পর যে অবিশ্বাস্য গল্প শুনিয়েছে তাতে আর বসে থাকা যায় না। ভেতরে নাকি অনেকগুলো সুরঙ্গ, তার গায়ে গায়ে হিরা, জহরত আর নীলকান্তমনি। আর অনেক গভীরে, পাথরের খাঁজে চকচক করছে রূপকথার আশ্চর্য সাপের মণি। সাইজ নাকি একটা নারকেলের সমান।
জমিদারবুর জন্য তারা দুই দুইটা নীলা এনে দিয়েছে, বড়টা মটর দানার চেয়ে বড়। বিশ্বাস না করে উপায় আছে!
৭।
মহেন্দ্রবাবু নামছেন, সাথে তাঁর দুই বিশ্বস্ত অনুচর কামরান আর হিন্দাল। উপর নিচ থেকে মহারাজকে গার্ড দিয়ে রেখেছে। হাতে মশাল জ্বলছে তাদের।
সুপ্রাচীন কুয়া। একশো ফুটের মতো নামার পর উপরের আকাশটা বহু দূরে ছোট একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো হয়ে গেল। মশাল ছাড়া আলোর কোন উৎস সেই।
কুয়ার দেয়াল এবড়ো থেবড়ো, আঠালো কি জানি শেওলা জমেছে সেখানে। উৎকট একটা গন্ধ বারবার নাকে আসছে।
মহেন্দ্রবাবুর কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। কামরান আর হিন্দাল কোনরকম ভরসা দিতে পারছে না। এখনো নাকি অনেক দূর।
গুহার দেয়াল একটু কেঁপে উঠলো মনে হলো না? নাকি সেটা তাঁর চোখের ভুল!
গন্ধটা কি আরও বাড়ছে?
৮।
চার ঘণ্টা পর।
কুয়ার দেয়াল স্পষ্ট কাঁপছে। মহেন্দ্র বাবুও একটু একটু কাঁপছেন।
পাথুরে দেওয়ালের চিহ্নমাত্র নেই। রত্নের তো প্রশ্নই ওঠে না। দেয়াল জুড়ে ঘন হয়ে জন্মেছে গোলাপি রঙের কি জানি। মনে হচ্ছে জিনিসগুলো থলথল করে নড়ছে।
মহেন্দ্র বাবুর ভয় লাগছে। খুব ভয়।
উপরে নিচে কামরান আর হিন্দাল দুই ভাই গার্ড দিয়ে তাকে নামাচ্ছে। নাকি নামতে বাধ্য করছে?
মহেন্দ্র বাবু থেমে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি আর যাবো না। এখুনি উপরে ব্যাক করো।
হিন্দাল ফিশফিশ করে বলল, হিশ, শব্দ করবেন না, ওরা আসছে।
কারা আসছে দেখার জন্য মহেন্দ্রবাবু নিচে তাকালেন। উল্টাপাশের সিঁড়ি দিয়ে তিনজন মানুষ উঠে আসছে। উপরের জন অবিকল কামরানের মতো দেখতে, নিচের জন হিন্দালের মতো। মাঝখানের জন মহেন্দ্র বাবু নিজে।
তাদের হাতে ঝলমল করছে মূল্যবান সব রত্ন পাথর। মশালের আলোয় তাদের মুখ আনন্দে চকচক করছে।
মহেন্দ্রবাবু ভয়ে ককিয়ে উঠলেন। নিচে যতদূর চোখ যায় এ কুয়ার শেষ নেই। মাংসল গোলাপি রঙের জিনিশগুলো দেয়াল জুড়ে থলথল করে নড়ছে। ঝাঁঝালো কি জানি একটা বের হচ্ছে সেগুলোর গা থেকে। পুরো কুয়াটা জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়াচড়া করছে।
দুই ভাই কোথায় নিয়ে চলেছে তাঁকে?
৯।
সকালে দরবার বসেছে।
জমিদার মহেন্দ্র বাবু প্রজাদের অভাবনীয় এক গল্প শোনাচ্ছেন। মন্দিরের কুয়ার নিচে নাকি সাত রাজার ধন পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই টাকা মহেন্দ্র বাবুর একার নয়।
ওই রত্ন পুরো গ্রামবাসীর।
কালকে থেকে পুরো গ্রামবাসী বেলচা গাইতি নিয়ে নেমে যাবে রত্ন উদ্ধারের কাজে। যা পাবে, তিন ভাগের দুই ভাগ তাদের, এক ভাগ খাজনা।
গ্রামের লোকজন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, জয় মহারাজ মহেন্দ্র বাহাদুরের জয়!
(অ্যানিহিলেশান উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে)