জুরাসিক ১



জুরাসিক
(স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের উদ্দেশ্যে)

১।
পেছনে খাড়া উঁচু, খটখটা পাথরের একটা পাহাড়। আকাশটাকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে সেটা। ঘন কুয়াশা আর মেঘে ঢাকা পড়েছে তার উপর দিকটা, চূড়া দেখা যাচ্ছে না।  
সামনে গহিন গহন জঙ্গল। যতদূর চোখ যায় গাছ আর গাছ।
ওই জঙ্গল পাড়ি দিতে হবে দিনের আলো থাকতে, তারপর রাত কাটাতে হবে সুবিধামত কোন খোলা জায়গায়। পরদিন ভোরে থাকতে হবে জঙ্গলের মাঝ বরাবর জলাভূমিটার তীরে।

মেঘ ডাকছে বারবার। দূরে, অনেক ওপরে,  পাহাড়ের গায়ে ওড়াউড়ি করছে নগ্ন শকুনের মতো দেখতে কতগুলো দানব।  শিকার নিয়ে মারামারি করছে ওরা, মেঘের গর্জন ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তাদের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ আর কর্কশ চিৎকার।
আর দেরী করা ঠিক হবে না। আপনি আর আপনার সঙ্গী জঙ্গলে ঢুকলেন।

২।
আদিম, অকৃত্রিম জুরাসিক জঙ্গল। হাজার হাজার পাইন গাছ, সাইকাসের ঝার, গিঙ্গোর ঝোপ। নানান জাতের আর রঙের ফার্ন – ট্রি ফার্ন, লতানো ফার্ন, আগাছার মতো সাইকাসের গা বেয়ে গজিয়ে ওঠা ফার্ন। এই আদিম অরণ্যে একটা গাছেরও ফুল নাই, ফল নাই,  নেই মৌমাছিদের গুঞ্জন, পাখির ডাক। আছে তেলাপোকা, মশা আর হাজার হাজার ঝিঝি পোকা। আর আছে ডাইনোসরের আতঙ্ক।

এই মুহূর্তে আদিম বনভূমি গুমোট হয়ে আছে ঝড়ের আগমনী বার্তায়। আশেপাশে সব নিশ্চুপ। হাতে বড় একটা ম্যাশেটি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝোপঝাড় কেটে আগাতে হবে।

ঝড় আসলো। কেঁপে উঠল জঙ্গল, দুলে উঠলো সাইকাসের দল। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। একটু পর বহু দূরে বাজের শব্দের জবাব দিলো রক্ত পানি করা একটা হুঙ্কার। এখন থামলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে, দিনের আলোর আর বেশি বাকি নেই।  এই নিষ্ঠুর জঙ্গলে কাউকে বিশ্বাস নেই। ২০ ফুট দূরে যে ঝোপটা নড়ে উঠলো সেখানে কি ওঁত পেতে বসে আছে ঝুঁটিওয়ালা এল্ভিসরাস? থপ করে বহুদূরে কি জানি একটা পড়ল, কেঁপে উঠলো মাটি। কোন দানবের পায়ের আওয়াজ নাকি ঝড়ে ডালপালা ভাঙ্গার শব্দ?

বিকালের দিকে ঝড় পরে আসলো। দেখা মিলল আমাদের প্রথম দানবের। ৩০ ফুট লম্বা, পিঠে লাইন করে অনেকগুলো তিনকোনা পাখনার মতো, লেজে বীভৎস বড় বড় কাটা, সামনে ছোট্ট একটা মাথা। এই মুহূর্তে গাছপালা খাচ্ছে স্টেগোসরাস্টা, ওকে বিরক্ত না করলে সেও আপনাকে কিছু বলবে না।

৩।
জুরাসিকের রাত। বনের সব পশুপাখি নাকি আগুনকে ভয় পায়। সারাদিনের উত্তেজনায় পেটে কিছু পরে নি। একটু খোলা জায়গা পেয়ে আগুন ধরিয়েছেন, ভেজা কাঠে অনেক কষ্টে ধরানো আগুনে ধোঁয়া হচ্ছে প্রচুর। ইঁদুরের মতো কয়েকটা মেগাজসট্রোডন ধরা হয়েছে, ঝলসে খেতে চিকেন ফাইয়ের মতো লাগছে। আশেপাশে গহীন জঙ্গল, ঝিঁঝিঁ ডাকছে একটানা, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর ডাক ছাপিয়ে ভেসে আসছে রক্ত হিম করা চিৎকার। তাড়াতাড়ি মোটামুটি শক্ত একটা ডালে মাচা বেঁধে ঘুমাতে হবে, সকালে অনেক কাজ।

সে আসলো নিশুতি রাতে, আপনি ঘুমানোর অনেক পর। যখন আসলো তখন থেমে গেলো সব চিৎকার, বন্ধ হলো ঝিঁঝিঁর ডাক। নিচে আগুনটা নিভুনিভু করে জ্বলছিল, পায়ের তলায় পিষে সেটাকে নিভিয়ে দেয় সে। আপনার ঘুম ভাঙল অনেক পরে, আপনার সঙ্গীর মরণ চিৎকার শুনে।

আপনার পা থেকে কয়েক ফুট নিচে দাড়িয়ে আছে কালো কুচকুচা একটা দানব, তার ৪০ ফুট লম্বা দেহটা সাপের মতো কিলবিল করছে। ডাইনোসর আলোসরাস তার হ্যাচেটের মতো চোয়ালটাকে ইচ্ছামত হা করতে পারে, সেই চোয়ালের মাঝে ঝকঝকা দাঁতের ফাঁকে ছটফট করছে আপনার সঙ্গীর দেহটা। দানবের একটা চোখ স্থির তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, বিরাট বড় নাকটা দিয়ে দুর্গন্ধের বাষ্প উঠছে।

৩।
চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার, আপনি ছুটছেন। ঝোপঝাড় চেপে আসছে, দুলে উঠছে ডালপালা, আপনাকে থামলে চলবে না। গহীন জঙ্গলে ঘন ডালপালার ফাকে ওটা আসতে পারবে না, তাই আপনাকে আরও গভীরে ঢুকতে হবে।
সেই কালো রাতে, হাতে একটা টর্চ আর একটা ছোট পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেলকে সাথে নিয়ে, আদিম জঙ্গলের সব বিপদ আপদকে পাশ  কাটিয়ে আপনি কিভাবে একটা গাছের মগডালে এসে উঠলেন আপনি জানেন না। গভীর রাতে আবার আসলো ঝড়। গাছের ডাল শক্তভাবে আঁকড়ে ঝুলে থাকলেন কোনমতে।

৪।
খুব ভোর। মেঘের সাগরে ঢাকা বনভূমি। ঝড় কেটে গেছে, কিন্তু হিম হয়ে আছে চারদিক। থপ করে দূরে  কোথাও ভারি কিছু একটা পড়ল, আপনি জেগে উঠলেন। দেখলেন এক অপার্থিব দৃশ্য।
দূরে, কুয়াশা ভেদ করে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে একজোড়া জিরাফোটাইটান। তাদের ৯০ ফুট লম্বা শরীরটা সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোর চেয়েও উঁচু। তারা একটা করে পা ফেলছে আর মাটি কাঁপছে থরথর করে।
আপনার ভাগ্য আপাতত ভালো, জিরাফোটাইটান মাংস খায় না। কিন্তু এ জঙ্গলকে বিশ্বাস নেই। ছোট পাখির মতো যে জীবগুলো ডালে ডালে উড়াউড়ি করছে খেয়াল করলে দেখবেন চোয়াল ভরা দাঁত আছে তাদের। পালকভরা ডানার নিচে লুকিয়ে রেখেছে ধারালো নখর।

আপনার গন্তব্য জঙ্গলের মাঝের ওই লেকটা। সেখানে গেলে মানুষের দেখা মিলবে, লেকের পারে অপেক্ষা করছে টাইম মেশিনটা। আবার ম্যাশেটি হাতে নিয়ে মাটিতে নেমে পড়তে হবে।

আপনি কিন্তু জানেন না, টাইম মেশিন ঠিকই আছে, লেকের পাড়ের ওই মানুষগুলো আর নেই। সবুজ শেওলাভরা পানিতে নাক ডুবিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে জলের দানো লাইয়াপ্লুরোডন!

৫।
প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে শুরু হয় জুরাসিক যুগ, শেষ হয় ১৪ কোটি বছর আগে। এরপরের ৮ কোটি বছর চলে ক্রেটাসিয়াস যুগ। জুরাসিক যদি হয় ডাইনোসরদের রৌপ্য যুগ, ক্রেটাসিয়াসকে বলা চলে স্বর্ণযুগ!

আজকে যদি লাইয়াপ্লুরোডনের হাত থেকে বাঁচতে পারেন, ক্রেটাসিয়াসে আবার দেখা হবে – টি-রেক্সের দেশে 🙂


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *