গভীর সমুদ্রে ৯
হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট
১।
বহুদিন ধরে আমরা গভীর সমুদ্রে নামছি আর নামছি। আমরা পার করে এসেছি আলোর রাজ্য, দেখে এসেছি টোয়াইলাইট জোনের দানবদের, ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার মিডনাইট জোনে ভূতুড়ে সব প্রাণীদের।
আজকে আমরা তলার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি।
এই জায়গাটা ভয়ঙ্কর। আপনার আশেপাশে কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির মতো কতগুলো জিনিস।
ভকভক করে ধোঁয়া বের হচ্ছে সেগুলো দিয়ে।
আপনার সাবমার্সিবল এই জিনিসের বেশি কাছে নেওয়া উচিত হবে না। ওই জিনিস বিষাক্ত।
কালো ধোঁয়ার সাথে বের হচ্ছে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড। আর নানান জাতের ভয়ঙ্কর গ্যাস।
শুধু যে বিষাক্ত তাও না।
পানি এখানে টগবগ করে ফুটছে।
তাপমাত্রা কোথাও ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোথাও ৪০০ ডিগ্রি।
প্রচণ্ড চাপে পানি বাষ্প হতে পারছে না।
কয়েকশো বায়ুমণ্ডলীয় চাপ। আপনার হাড়গোড় কাগজের মতো গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
প্রচণ্ড তাপমাত্রা, ভয়ঙ্কর চাপ, বিষাক্ত পানি – এই জায়গায় প্রাণের বেঁচে থাকা অসম্ভব – এই চিন্তা করে আপনি যদি ঘুরে যান, বিশাল একটা জিনিস মিস করবেন।
গভীর সমুদ্রের ওই দোজখতুল্য আগ্নেয়গিরি আসলে প্রাণের স্বর্গরাজ্য।
ওই ভেন্টগুলোর প্রতিটা ইঞ্চি জায়গা ছেয়ে আছে নানান জাতের আজব প্রাণীতে।
ওই দেখেন – পম্পেই ওয়ার্ম। ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে ইতালির পম্পেই নগরী ধ্বংস হয়েছিলো মনে আছে? সেই নগরীর নামে এদের নাম।
ওই দেখেন, জায়ান্ট টিউব ওয়ার্ম। ছয় ফুট লম্বা, লাল টকটকা, নরকের সাপের মতো প্রাণী। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত পানির প্রতিটা ইঞ্চি জায়গা দখল করে তিরটির করে নড়ছে । এদের পেট নেই, মুখ নেই, চোখ নেই। এরা খাবার শুষে নেয় চামড়া দিয়ে।
আছে পাম ওয়ার্ম। ফুলের মতো মুখে ৫টা করে পাপড়ি। বিষাক্ত ধাতুর সমুদ্রে মহানন্দে আছে।
শুধু কি ওয়ার্ম? মাছ আছে, শামুক আছে। আছে হাজার হাজার রোমশ কাঁকড়া। ইয়েতির মতো ঘন রোমে ঢাকা এদের দাঁড়া, অনেকে নাম দেয় ইয়েতি ক্র্যাব। সেই সাথে আছে অক্টোপাস। গভীর সমুদ্রের অন্য জায়গার চেয়ে ১০ হাজার গুন বেশি প্রাণী ভিড় করে আছে ওই ভয়ঙ্কর এলাকায়।
প্রশ্ন হলো, কি আছে ওখানে?
২।
ওইখানে, নিকষ কালো অন্ধকারে, সূর্যের আলো থেকে বহু দূরে বাস করে কেমোসিন্থেটিক ব্যাকটেরিয়ারা। তারা অক্সিজেনের প্রায় অনুপস্থিতিতে, সূর্যের আলো থেকে বহু দূরে বসে, বিষাক্ত সালফার দিয়ে তৈরি করে পুষ্টিকর খাবার। তাদের একেকজনের সহ্য ক্ষমতা অসাধারণ, অনেকে ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বংশবিস্তার করে।
যদি কোনদিন সূর্যের আলো নিভে যায়, ডাঙ্গার গাছগুলো সব মরে যাবে। একে একে মরবে সব প্রাণীরা। শুধু বেঁচে থাকবে গভীর সমুদ্রের সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ওই আজব ব্যাকটেরিয়ারা, আর তাদের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা ওয়ার্ম আর মাছরা।
বারবার যখন পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, টিকে গিয়েছিল ওই জীবজগত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আজ থেকে ৩৭০ কোটি বছর আগে এমনি কোন এক হাইড্রোথার্মাল ভেন্টে প্রচণ্ড চাপ আর তাপে, ভয়াবহ বিষাক্ত পরিবেশে জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম প্রাণ!
সে গল্প নাহয় আরেকদিন বলা যাবে।
Sharif
Osadharon