ক্রেটাসিয়াস ২



ক্রেটাসিয়াস ২

১।

কোয়েটজালকোয়াটল নামটা বিশাল, লিখতে গেলে খবর হয়ে যায়। নিজের প্রয়োজনেই ধরে নিচ্ছি, পানির ধারে এসে সর্পদেবী অবশেষে টের পেলো তার ঘাড়ে উকুনের মতো একটা উটকো ঝামেলা চেপে বসেছে। সে হুট করে ঘুরে তাকিয়ে ঘাড় ঝাড়া দিলো, আপনিও টুপ করে পানিতে পরে গেলেন।

ক্রেটাসিয়াসের সমুদ্র উত্তাল, ঢেউয়ের পরতে পরতে সেখানে মুখ লুকিয়ে থাকে ভয়ঙ্কর সব দৈত্য দানো। কয়েক মাস গভীর সমুদ্রে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে এই মুহূর্তে সেখানে জেগে উঠেছে দানব কাছিম আরকিলন। তার পনের ফুট বিশাল শরীরটায় খোলসটা আছে নিচের দিকে। কি করব বলেন, একেবারে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, জামাটাও ঠিকমতো পরতে শেখে নি! প্রিয় পাঠক, খুব লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নেন, আর্কিলনের পিঠে চড়ে আমরা ডুব দিবো ক্রেটাসিয়াসের গভীর সমুদ্রে!


২।

ক্রেটাসিয়াসের মাটির উপর রাজত্ব করত নানান জাতের ডাইনোসররা, পানির দুনিয়ায় তাদের জায়গা দখল করেছিলো নানান জাতের সাগর দানোরা।

ডলফিনের মতো চেহারার মাছের মতো দেখতে সরীসৃপদের নাম ছিল ইকথাইওসর – ফিশ রেপ্টাইল।

বিশাল লম্বা গলাওয়ালা সরীসৃপদের নাম প্লেসিওসর, তাদের চারটা করে পাখনা প্যাডেলের মতো সাঁতার কাটে।

সাপের মতো চেহারার অনেকটা কমোডো ড্রাগন টাইপ দাঁতালো দানবদের নাম মোজেসর।

ইকথাইওসর শনিসরাসের গল্প ট্রায়াসিক পর্বে বলেছি, আজকে বলব বাকি দুই জনের গল্প।

৩।

লক নেসের দানব নেসির কথা মনে আছে? ঐযে বিশাল লম্বা গলা, পিঠের উপর উটের মত কুজ? নেসি থাকে স্কটল্যান্ডের লক নেস নামের লেকে, বহুদিন পরপর একবার মাথা তুলে আকাশটা দেখার চেষ্টা করে।

নেসির অস্তিত্ব সত্যি সত্যি ছিল কিনা জানি না। অল্প কিছু ছবি পাওয়া যায়, ফেক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক।

সত্যিকারের যে প্রাগৈতিহাসিক দানব নেসির গল্পের জন্ম দেয় তার নাম প্লেসিওসর। এই পর্যন্ত অনেক জাতের প্লেসিওসরের ফসিল পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ইলাজমোসরাস। তার ৫০ ফুট লম্বা ৫ তলার সমান বিশাল শরীরটার বেশিরভাগ জায়গা জুরে আছে জিরাফের মতো লম্বা একটা গলা। ওই গলাটা একেবেকে সে শিকার করতো ক্রেটাসিয়াসের দানব মাছ আর অন্যান্য সব সরীসৃপদের। ইলাজমোসরাস হলো সরীসৃপ, কুমিরদের মতোই সে পানিতে শ্বাস নিতে পারতো না। বুকের মাপ দেখে বুঝা যায় তার ছিল বিশাল একটা ফুসফুস, একবার নিশ্বাস নিলে ১০ মিনিট পর্যন্ত বাতাস ধরে রাখতে পারতো।

কোথাও কোন ইলাজমসরাসের ডিম পাওয়া যায় নি, ধারণা করা হয় সে আস্ত বাচ্চা দিতো ম্যামালদের মতো।


৪।

জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের মোজেসরাসের কথা মনে আছে? ঐযে বিশাল পানির দানব, যার সকালের নাস্তা ছিল গ্রেট হোয়াইট শার্ক আর রাতের ডিনার ছিল ডাইনোসরের মাংসের কাবাব? প্লেসিওসররা যেমন জন্ম দিয়েছে লক নেসের মনস্টারের গল্প, মোজেসেসরদের হাড় গোড় আড় ফসিল তেমনি জন্ম দিয়েছে সাগর দানবদের গল্প।

নর্স মিথলজিতে আছে সুবিশাল মিডগার্ড সার্পেন্টের কাহিনী, যে কিনা এতো বড় যে, পুরা পৃথিবীটাকে সে একপাক পেঁচিয়ে ফেলতে পারবে। মহাজ্ঞানী গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটল historia animalum এ আরেক দানবের কাহিনী বলে গেছেন, যে মুখ খুললে আস্ত ঘোড়ার শুদ্ধ মানুষ পেটে ঢুকে পরতে পারে। ১৭৩৪ সালের ৬ই জুলাই হ্যান্স এগেড নামের নাবিক গ্রিন ল্যান্ডের কাছাকাছি সমুদ্রে জাহাজের ক্রোস নেস্ট থেকে তাকিয়ে দেখেন এমনি আরেক ভয়াবহ সাগর দানো, আকারে যে কিনা তার জাহাজটার চেয়েও অনেক বড়, আর চেহারাটা এমন ভয়ঙ্কর যে, আমাদের পরিচিত কোন কিছুর সাথে তার কোন মিল নেই।


আবারও, এই কাহিনীগুলোর সত্যতা আমি দাবী করছি না, তিলকে তাল বানানো মানুষের স্বভাব। এগুলোর উৎস হিসাবে ধরা যায় প্রাগৈতিহাসিক মোজেসরের হাড়গোড়কে। মোজেসরদের প্লেসিওসরদের মতো লম্বা গলা নেই, তাদের চিকন চ্যাপ্টা দেহটা স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য খুবই উপযোগী। শরীরটা ৫০ ফুট, ৫ তলার সমান লম্বা। ঝকঝকা দাঁতের মাথাটা বহু প্রাণীর হাড়গোড় চিবিয়ে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আপনি যেই পনের ফুট লম্বা সি টারটলটার পিঠে আছেন, সেটা মোজেসরাসের খাবার, তাই আপনাকে অনেক সাবধান হতে হবে।

৪।

মাটিতে ডাইনোসর, আকাশে টেরোসর, পানিতে সাগরদানো – প্রাণের এই অভূতপূর্ব মহাযজ্ঞ চিরদিন চলবে না। এই নিয়ে চারবার পৃথিবীর প্রাণিজগৎ ধ্বংস হয়ে গেছে, আরও একবার হবে।

এবারের কালপ্রিটটার নাম চিক্সালাব। সে একটা অ্যাস্টেরয়েডের টুকরা। দানবীয় উল্কাটার সাইজ ধারণা করা হয় ১১ থেকে ৮১  কিলোমিটার পর্যন্ত। মেক্সিকোর চিক্সালাব অঞ্চলে সে যেই ক্ষত রেখে গেছে তার ব্যাস ১৫০ কিলোমিটার।

ডাইনোসর ধ্বংসের আমরা যেই ছবিটা মনে মনে চিন্তা করি – বিরাট বড় একটা উল্কা আঁচড়ে পড়ল আর ডাইনোসররা সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো, ব্যাপারটা আসলে সেরকম না। মৃত্যু জিনিসটা স্লো, করুণ, ভয়ঙ্কর। উল্কাপাতে আশেপাশের প্রাণীরা মারা যায় ঠিকই, সাড়া পৃথিবীতে তার প্রভাব ছড়িয়ে পরতে সময় লাগে। উল্কার ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পরে, একেবারে স্ট্রাটোস্ফিয়ার পর্যন্ত। সূর্যের আলো আসা খুব কমে যায়। পৃথিবীটা তখন ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন জগত। আলো আসা খুব কমে যাওয়ায় বড় বড় গাছরা মরে সালোকসংশ্লেষণের অভাবে। না খেতে পেরে আস্তে আস্তে মারা যায় বিশাল তৃণভোজী ডাইনোসররা। শেষে মারা যায় তাদের খেয়ে যারা বেঁচে থাকতো সেইসব মাংসাশী প্রাণীরা।  

কতদিন ধরে মড়ক চলেছিল বিতর্ক আছে। কেউ বলে কয়েক বছর, কেউ বলে কয়েক হাজার। পৃথিবীর ৭৫ ভাগ প্রাণী এই মহাধংসজজ্ঞে মারা যায়। কিছু কুমির ছাড়া, ২৫ কেজির বেশি ওজনের কোন মাটির প্রাণী রক্ষা পায় নি। একমাত্র পাখি ছাড়া প্রায় সব ধরনের ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাগরে ভাসতে থাকে মোসেসর আর প্লেসিওসরদের লাশ।

৫।

শেষ করার আগে একটা ভালো খবর দিয়ে যাই। ডাইনোসরের যুগের শেষে এসে, ক্রেটাসিয়াস যুগে গাছরা ফুল ফুটাতে শিখে গেছে। ফুল আর মৌমাছি, প্রজাপতিতে ভেসে গেছে চারদিক।

এই গাছগুলো সব ধ্বংস হয় নি উল্কাপাতে, কেউ কেউ টিকে গেছে সবকিছু সহ্য করে। সামনে আসছে ম্যামালদের যুগ, নতুন পৃথিবীকে ফুল ফল আর অক্সিজেন দিয়ে ভরে দিতে এই গাছগুলোর খুব দরকার হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *